মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
নালন্দার শিক্ষা ঐতিহ্যের সমপর্যায়ের একটি মহাবিহার হিসেবে অষ্টম শতাব্দীতে পাল সম্রাট ধর্মপাল বিক্রমশীলা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। হাজারো শিক্ষার্থী এবং প্রায় দুইশ শিক্ষকের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল সেখানে। বিক্রমশীলার পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলায় প্রচলিত বৌদ্ধ ধারার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। শুধু তাই নয়, সপ্তম শতাব্দী থেকেই তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের ওপর বাংলার বৌদ্ধগুরুদের প্রবল প্রভাব ছিল। তাদের মতবাদই তিব্বতের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো। বিক্রমশীলা এর ব্যতিক্রম ছিল না। এখানে বাইরে থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী আসতেন। এক সময় এর প্রধান আচার্য ছিলেন বাংলার সন্তান শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমাশীলার পাঠ্যক্রমে দর্শন, চিকিৎসা, সমাজ বিজ্ঞান আর অঙ্ক শাস্ত্র অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন।
ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে ৯৮০ সালে স্থানীয় রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। ছেলেবেলায় পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে দেখা পান জেতারি নামে এক সাধুর। তার কাছ থেকে অধ্যাত্মিক শিক্ষার সূচনা হয় তার। কালশিলা পাহাড়ে তান্ত্রিক গুরু রাহুলগুহ্যবজ্র তাকে পরবর্তী ধাপের শিক্ষা দেন। ২৯ বছর বয়সে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। এসময় তার শিক্ষক ছিলেন আচার্য ধর্মরক্ষিত। দুই বছর পর তিনি বৌদ্ধগুরু আচার্য ধর্মকীর্তির কাছ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিতে কাঠের জাহাজে চড়ে সুবর্ণদ্বীপ বা বর্তমানের ইন্দোনেশিয়া যান। সেখানে জ্ঞান সাধনায় কাটে বারো বছর। দেশে ফিরে আসেন ৪০ বছর বয়সে। সে সময়ের বাংলার বিখ্যাত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র বা বিশ^বিদ্যালয় ওদন্তপুরী ও সোমপুর বা পাহাড়পুর বিহারে শিক্ষকতা করে পরবর্তীতে তিনি বিক্রমশীলা বিহারের আচাযের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে একবার একটি বড় বৌদ্ধ সম্মেলন হয় যাতে আট হাজার ভিক্ষু অংশ নেন। তারা সমবেত ভাবে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করকে বিক্রমাশীলার প্রধান আচার্য পদে মনোনীত করেন। একজন আন্তর্জাতিক স্কলার হিসেবে ততোদিনে অতীশ দীপঙ্করের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে। তার লেখা বই পঠিত হয় বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে।
গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় চৌদ্দশ বছর পর অতীশ দীপঙ্কর জন্ম গ্রহণ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার জন্মের বহু আগেই বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। তিব্ববে রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ হলেও ধর্মীয় শুদ্ধতা নিয়ে স্থানীয় শাসকরা চিন্তিত ছিলেন। তারা প্রথমে ২১ শিক্ষার্থীকে বাংলায় পাঠান প্রকৃত শিক্ষা নিতে। কিন্তু তাদের পক্ষে তিব্বতের অবিদ্যা দূর করা অসম্ভব ছিল। তবে তারা অতীশ দীপঙ্করের নাম প্রস্তাব করেন। তিব্বতের শাসকরা তাকে নিয়ে যেতে নানা রকম প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিব্বতের ধর্মীয় সংস্কারের প্রার্থনা জানিয়ে রাজা এশেউদ একটি রাজকীয় প্রতিনিধি দল পাঠান অতীশ দীপঙ্করের কাছে। কিন্তু অতীশ দীপঙ্কর যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিব্বতবাসী আশা ছাড়েন নি। রাজা এশেউদের মৃত্যুর পর তার ভাইয়ের ছেলে ওদদে রাজা হন। রাজা ওদদে নিজেই তার ভাই রাজভিক্ষু জনছুবওদকে নিয়ে একটি রাজকীয় দলসহ অতীশ দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা করে ধর্মরক্ষার জন্য বিনীত আবেদন জানান। এবার অতীশ দীপঙ্কর রাজি হন।
৫৯ বছর বয়সে তিনি অজ দুর্লভ পুঁথি নিয়ে তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন তার কয়েকজন শিষ্য; অতীশ দীপঙ্করের ছোট ভাই বীর্যচন্দ্র, পশ্চিম ভারতীয় রাজা ও রাজভিক্ষু ভূমিসঙ্ঘ, প -তি ভূমিগর্ভ, দোভাষী নাগাছো ছুলধিম জলবা প্রমুখ। পথে এক বছর সময় তিনি কাটান নেপালে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও সংস্কারের কাজে। নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি তাকে গভীর শ্রদ্ধায় বরণ করে নেন। অতীশ দীপঙ্করের উদ্যোগে রাজা অনন্তকীর্তি নেপালে ‘থম’ নামে একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি অতীশ দীপঙ্কর ‘চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ’ বইটি লেখেন এবং প্রজার মঙ্গলে করণীয় ও রাজ্য শাসন বিষয়ে ‘বিমলরতœলেখ’ নামে একটি দীর্ঘ দিকনির্দেশনা মূলক চিঠি লিখে পাঠান বাংলা-বিহারের পাল সম্রাট নয়াপালকে।
দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে পৌঁছান। তখন তার বয়স ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। এই বয়সে হিমালয়ের দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য। এই বিষয়টি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন এভাবে, ‘বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ঙ্কর/ জান্নালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালি দীপঙ্কর।’
তিব্ববে অবিদ্যা দূর করতে অবিশ্রান্ত শারীরিক পরিশ্রম করেন অতীশ দীপঙ্কর। একই সঙ্গে লিখতে থাকেন একের পর এক বই। তিব্বতের তেরো বছর বসবাসকালে অতীশ দীপঙ্কর অনেকগুলো বই লেখেন। এর মধ্যে ধর্ম, চিকিৎসা, নীতিজ্ঞানসহ নানা বিষয় ছিল। তিনি চিকিৎসা চর্চাকে তিব্বতে ছড়িয়ে দেন। মৌলিক বইয়ের পাশাপাশি ছিল অনুবাদের কাজ। অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতের মানুষ ‘জোবো জে’ অর্থাৎ মহাগুরু হিসেবে সম্বোধন করতেন। তবে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘অতীশা’ নামেই বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। পশ্চিম তিব্বতের এ্যারিতে প্রথম উপস্থিত হন তিনি। এরপর বিভিন্ন সময়ে পালথত, চাঙ, ন্যাঙ ছো, রোঙ, লাসা, সাম ইয়ে প্রভৃতি স্থানে তিনি ধর্ম সংস্কারের কাজ করেন। তিনি তিব্বতে বৌদ্ধ ভাবাদর্শের আধুনিকায়নে অবদান রাখেন। জটিল ধর্মীয় তত্ত্বকে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন। তার প্রভাবে ‘গেলুগ’ বৌদ্ধ দর্শনের স্কুল গড়ে ওঠে।
তিব্বতে অতীশ দীপঙ্করের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তার প্রিয় শিষ্য ডোম-তোন পা। মৃত্যুর আগেই ডোম-তোন পাকে নিজের উত্তরসুরী হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি। অতীশ দীপঙ্করের মৃত্যুর পর ডোম-তোন পা প্রভাবশালী ‘কাদমপা’ গোষ্ঠী তৈরি করেন। পুরো চায়নায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে অতীশ দীপঙ্করের ভূমিকার কথা এখনো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। চায়নার পাশাপাশি জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও তিব্বত সংস্কৃত শিক্ষাধারার প্রতিনিধিত্ব করছে যার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শান্তরক্ষিত ও অতীশ দীপঙ্করের। তিব্বতে দালাই লামা এবং অন্যান্য ধর্মগুরুগণ এখনো অতীশ দীপঙ্করের প্রবর্তিত ধারায় বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা করেন যা পৃথিবীর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুসরণীয় পথ। তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা নিয়মিতই অতীশ দীপঙ্করের বই থেকে নানা শিক্ষা তার অনুসারীদের সামনে তুলে ধরেন।
মৃত্যুর পর থেকে তিব্বতের নেথাং মন্দিরে অতীশ দীপঙ্করের দেহভস্ম এবং যে পাথর খ-টির ওপর বসে তিনি মেডিটেশন করতেন তা রাখা আছে। ১৯৬৩ সালে ঢাকা থেকে ধর্মগুরু শুদ্ধানন্দ মহাথেরো চায়না গেলে অতীশ দীপঙ্করের দেহভস্মের অংশ বিশেষ দেশে আনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালের জুনে দুই দেশের সরকারের আন্তরিকতায় অতীশ দীপঙ্করের দেহভস্মের অংশ বিশেষ ঢাকায় পাঠানো হয়। যা কমলাপুরে বৌদ্ধ বিহারে রাখা আছে। চায়না সরকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্করের স্মরণে একটি স্মৃতি স্থাপনা নির্মাণ করে দেয়। এর পাশেই একটি হল রুম ও পাঠাগার গড়ে ওঠেছে অতীশ দীপঙ্করের নামে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক