স্কুলের পথে
কমিরুদ্দীনও কয়েকবার ফেল করিয়া পড়া ছাড়িয়া দিল। আজ মনে পড়িতেছে, আমার পিতা হিতৈষী স্কুলে মাস্টারি লইলেন, তিনি আমাদের গ্রামের বহু ছেলেকে আনিয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিয়াছিলেন। বরান খাঁ, ইসমাইল, ফইজদ্দীন মোল্লা, ভুমুরদ্দী এই কয়জনের নাম মনে পড়িতেছে। ইহারা সকলেই কৃষাণ-ঘরের ছেলে। স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রই ছিল শহরের। তাহাদের পিতা-মাতা লেখাপড়া জানিত। স্কুলে মাস্টার পড়া দিয়া দিলে বাড়িতে যাইয়া অভিভাবকদের সাহায্যে সেই পড়া তৈরি করিয়া স্কুলে আসিত। আর গ্রামের ছেলেরা সন্ধ্যাবেলায় কেরোসিনের কুপি জ্বালাইয়া বইপত্র খুলিয়া বসিয়া থাকিত। কিন্তু কে তাহাদিগকে পড়া শিখাইয়া দিবে? পুস্তকে-লিখিত সেই অজানা বিদ্যার সঙ্গে বহুক্ষণ বৃথা লড়াই করিয়া তাহারা ঘুমাইয়া পড়িত। তাহারা যে চেষ্টা করিয়াও পড়া তৈরি করিতে পারে নাই স্কুলের কেহই তাহা বুঝিত না। প্রতিদিন বেঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া, নিলডাউন, হাফ নিলডাউন হইয়া শিক্ষকদের বেত্রাঘাত খাইয়া তাহাদের স্কুল-জীবন গ্রাম্য-মৌলবি সাহেব বর্ণিত দোজখের মতোই মনে হইত।
এইভাবে বহু লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করিয়া একে একে তাহারা সকলেই পড়া ছাড়িয়া দিল। আজও গ্রামদেশের কোনো পাঠশালা বা স্কুলে গেলে এই দৃশ্যই সকলের আগে আমার চোখে পড়ে। প্রত্যেক অবৈতনিক পাঠশালার শিশুশ্রেণীতে কমসে কম ষাট-সত্তরজন ছাত্র ভর্তি হয়। এই ছাত্রসংখ্যা ধীরে ধীরে কমিতে কমিতে পঞ্চম শ্রেণীতে আসিয়া সাত-আটজনে পরিণত হয়। ইহার কারণ অনুপযুক্ত শিক্ষকেরা শিশুশ্রেণীর ছাত্রদের ভালোমতো পড়াইতে জানে না। বাংলা ভাষায় যুক্তবর্ণসমেত প্রায় সাড়ে পাঁচশত বর্ণমালা। ইসলামি শিক্ষার প্রতি অতিআগ্রহের জন্য বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়েই আরবি অথবা উর্দু বর্ণমালা শিক্ষা দেওয়া হয়। আগেই বলিয়াছি আরবি বর্ণমালা শব্দের এক এক স্থানে এক এক রূপ গ্রহণ করে। সেইজন্য প্রায় দুইশত বর্ণমালা না শিখিলে উর্দু পড়া যায় না। তাহা ছাড়া উর্দু পুস্তকে আকার-উকার থাকে না বলিয়া এই ভাষা জানা না থাকিলে অথবা কাহারও সাহায্য না লইলে উর্দু পুস্তক পড়া যায় না।
বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীতে বর্ণমালা শিখাইবার যেসব নতুন নতুন নিয়ম আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা পাঠশালার শিক্ষকেরা জানে না। কেহ কেহ জানিলেও ছাত্রদিগকে শিখাইতে সেইসব প্রণালী অবলম্বন করেন না। তাঁহারা ছাত্রদিগকে পড়া দিয়া দেন। পড়া না পারিলে তাহাদের প্রতি নানাপ্রকার শাস্তির ব্যবস্থা করেন। শুধুমাত্র বর্ণমালার অত্যাচারেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি হইতে প্রতি বৎসর শতকরা নব্বইজন ছাত্র স্কুল হইতে বাহির হইয়া যায়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আমাদের রাষ্ট্র প্রতি বৎসর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন। এই টাকাটা আসে গ্রাম্য চাষীদের দেয় শিক্ষাকর হইতে। যাহারা এই ব্যয় বহন করে তাহাদের ছেলেরা অধিকাংশই ইহার সুযোগ হইতে বঞ্চিত হয়। এই অবিচার আর কত দিন চলিবে? আমাদের প্রস্তাব, প্রাইমারি স্কুলগুলিতে বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাই যেন শিক্ষা দেওয়া না হয়। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যেন বাংলা ভাষাই ব্যবহার করা হয়। আর বর্ণমালা শিখাইতে শিক্ষকেরা যাহাতে আধুনিক শিক্ষা-প্রণালী গ্রহণ করেন, কর্তৃপক্ষ যেন সেইদিকে নজর দেন।
যাক এসব কথা। এত অসুবিধার মধ্যেও আমার কিন্তু পড়িবার খুব ইচ্ছা হইত। কিন্তু কে আমাকে পড়াইয়া দিবে? আমার পিতা ইংরেজি জানিতেন না। ইংরেজিতেই আমি সবচাইতে কাঁচা। জেলা স্কুলে যাইয়া ভালো ভালো ছেলেদের সঙ্গে মিশিবার চেষ্টা করিতাম। গ্রীষ্মের ছুটির সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিতাম, আমিও তাহাদের মতো পরীক্ষায় ভালো পাশ করিব। গ্রীষ্মের ছুটির সময় প্রতিদিন চৌদ্দ পনরো ঘণ্টা করিয়া পড়িবার রুটিন তৈরি করিয়া লইতাম। ভাবিতাম এইভাবে যদি একমাস পড়িতে পারি তবে আমিও ক্লাসে প্রথম হইতে পারিব। কিন্তু আমগাছে আম পাকিয়া লাল হইত। পাখির বাসায় নতুন ছানা চিচি করিত। ছোট গাঙের পুলের ধারে সমবয়সীরা বড়শি দিয়া বামমাছ ধরিত। এসব আকর্ষণ আমার মনটিকে সেই রুটিনের ছোট্ট কুঠরিগুলি হইতে কাড়িয়া আনিত। ছুটি ফুরাইয়া গেলে মাথায় হাত দিয়া বসিতাম। হায় হায় কি করিয়াছি! এই এক মাসে যা কিছু পড়া ছিল তাও যে ভুল হইয়া গিয়াছে। স্কুল খুলিলে আবার ভালো ছেলেদের সঙ্গে মিশিতে চেষ্টা করিতাম।
চলবে…