সারাক্ষণ রিপোর্ট
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগে আইসিডিডিআর,বি, ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি (ইউটিএস) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আইটিএন সেন্টারের যৌথ প্রচেষ্টা। ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে তারা স্থাপন করেছে দেশের প্রথম কম খরচে ও টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধনাগার (ডব্লিউডব্লিউটিপি)। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেটেড হেলথ সায়েন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের অর্থায়নে নির্মিত এই প্লান্ট বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (ইসিআর) ২০২৩-এর নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন থেকে দেশের সব হাসপাতালে বর্জ্য পানি পরিশোধন ব্যবস্থা গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস ইউনিট, মহাখালী, ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় “ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বল্প খরচে টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধন ও পুনঃব্যবহার” শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল উন্মোচন করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী, ৫০ শয্যার বেশি ধারণক্ষমতার হাসপাতালগুলোকে ‘রেড’ ক্যাটাগরি প্রকল্প বলে গণ্য করা হয়, যেগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করে। এসব হাসপাতালে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক হলেও ঢাকায় এখনো কার্যকর দ্বিতীয় স্তরের পরিশোধন ব্যবস্থা বা পূর্ণাঙ্গ ইটিপি চালু হয়নি।
সমস্যার শুরু ও প্রয়োজনীয়তা
অনেক হাসপাতাল এখনো সেপটিক ট্যাংক কিংবা এনঅ্যারোবিক ব্যাফল রিঅ্যাক্টরের মতো পুরনো প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো কার্যকরভাবে বর্জ্য পানি শোধন করতে পারে না। ফলে, অপরিশোধিত বর্জ্যপানি আশপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া এবং ক্ষতিকর রাসায়নিকের কারণে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করে। এতে রোগ সংক্রমণ এবং পরিবেশগত দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।
উদ্ভাবনী ডব্লিউডব্লিউটিপি-এর সাফল্য
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে চালু হওয়া নতুন মেমব্রেন বায়োরিঅ্যাক্টর (এমবিআর) ভিত্তিক পানি পরিশোধনাগারটি দৈনিক ২৪ কিলোলিটার বর্জ্য পানি শোধন করতে সক্ষম। ছয়-ধাপের আধুনিক এ প্রক্রিয়ায় বর্জ্য পানি থেকে এমন পানি উৎপাদন করা হয়, যা বাগান পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য অ-পানীয় কাজে ব্যবহারযোগ্য।
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়:
- ১০০% বর্জ্য পানি থেকে মলের জীবাণু (ই কোলাই), ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া (ইএসবিএল ই কোলাই), ভিব্রিও কলেরা ও সালমোনেলা টাইফি অপসারণ সম্ভব।
- রোটাভাইরাস এ-এর ৯৯% হ্রাস নিশ্চিত করে।
- বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩-এর নির্ধারিত মান পুরোপুরি মেনে চলে।
কমপ্যাক্ট ডিজাইন, কম অপারেশনাল খরচ এবং একজন অপারেটরের দ্বারা সহজে পরিচালনার সুবিধার কারণে এটি বাংলাদেশসহ অন্যান্য নিম্ন-আয়ের দেশের জন্য একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ ও মন্তব্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর ডা. মোঃ জয়নাল আবেদিন টিটো এই প্রকল্পের প্রশংসা করে বলেন,
“বাংলাদেশ সরকার, আইসিডিডিআর,বি ও ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। আশা করি এর মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখা যাবে। এটি স্বল্প খরচের সহজ প্রযুক্তি হওয়ায় দেশের সব হাসপাতালে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এগিয়ে যাবো।”
মডেল সম্প্রসারণের সম্ভাবনা
আইসিডিডিআর,বি-র এনভায়রনমেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ ইউনিটের সহযোগী বিজ্ঞানী ও গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ডা. মোঃ নুহু আমিন বলেন,
“এই প্লান্ট এখন আর পরীক্ষামূলক স্তরে নেই; এটি একটি প্রমাণিত, স্বল্প খরচের কার্যকর প্রযুক্তি। আমরা দেশের অন্যান্য উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালে এটি সম্প্রসারণে প্রস্তুত, যা রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং পানি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় সাফল্য এবং বিশ্বের অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি অনুকরণীয় উদাহরণ।”
বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন,
“এই সহজ ও প্রমাণিত পদ্ধতি জাতীয়ভাবে সম্প্রসারণযোগ্য। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে এটি মূলধারায় নিয়ে আসতে পারলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা যাবে।”
সারসংক্ষেপ
দেশের প্রথম টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধনাগার স্থাপনের ফলে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্যখাতের আধুনিকায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের নীতিগত সমর্থন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কারিগরি জ্ঞান এবং কম খরচে উন্নত প্রযুক্তি—সব মিলিয়ে এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে হাসপাতাল বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনায় একটি গেম-চেঞ্জার হয়ে উঠতে পারে।