মনাদা
পরদিন ভোর না হইতেই আমি কিছু জিকার আঠা লইয়া উকিল লাইব্রেরির নোটিসবোর্ডে সেই প্রতিবাদপত্র আটকাইয়া দিয়া আসিলাম। তাহা পড়িয়া বার লাইব্রেরির উকিলেরা পূর্ণবাবু ও মথুরাবাবুকে ছি ছি করিতে লাগিলেন। তাঁহারাও দুইজনে এই দেওয়ালপত্র পড়িয়া ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। তখনকার দিনে বিপ্লবী ছাত্রদের প্রভাব ছিল অসামান্য। তাঁহারা মনে করিয়াছিলেন, এই দেওয়ালপত্র বিপ্লবী ছাত্রেরাই লিখিয়াছে। তারপর দুইজনে একত্র হইয়া দুই স্কুলের হেডমাস্টারদের নিকট যাইয়া তাঁহাদের পূর্ব পত্র প্রত্যাহার করিলেন। ছেলেরা আবার দলে দলে যাইয়া সাহায্যকাজে ব্রতী হইল। কিন্তু সেই সাহায্যকার্যের অন্তরালে যে আমাদের দুইজনের কতখানি হাত ছিল তাহা কেহই জানিল না। আজও মনাদার সঙ্গে দেখা হইলে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করিয়া আবার আমাদের পূর্বজীবনে ফিরিয়া যাই।
মনাদার লিখিত সামান্য দুইখানা পত্রের ফলে ফরিদপুর শহরে এত কাণ্ড হইল। শত শত ছাত্র অসহায় গ্রামবাসীদের সাহায্যে ঝাঁপাইয়া পড়িল। দেখিবার সে এক দৃশ্য। ছাত্রেরা দলে দলে মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙিয়া কাঁধে করিয়া দূরবর্তী স্থানে লইয়া যাইতেছে। ছোট ছোট ছেলেরা তৈজসপত্র হাঁড়ি-কুড়ি মাথায় করিয়া সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছে। অসহায় গ্রামবাসীরা অশ্রুসজল চক্ষে নীরব কৃতজ্ঞতা জানাইতেছে। এই ঘটনায় আমরা বড়ই উৎসাহিত হইয়া পড়িলাম। আমাদের সাহিত্য-সাধনা আরও মনোযোগের সহিত চলিল। একদিন মনাদাকে বলিলাম, “আসুন, আমরা একখানা মাসিকপত্র বাহির করি।” মনাদা তৎক্ষণাৎ রাজি হইলেন। পত্রিকার নাম স্থির হইল “ঊষা’। শহরের কোনো ভদ্রলোকের জামাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি উষা পত্রিকার মলাটের ছবি আঁকিয়া দিলেন। ‘সাঁঝের মায়া’ নাম দিয়া মনাদা এক বিরাট নভেল লেখায় হাত দিলেন। কয়েকদিনেই তিনি প্রায় শ’খানেক পৃষ্ঠা লিখিয়া ফেলিলেন। স্থানীয় ‘আর্যকায়স্থ’ পত্রিকার সম্পাদক ও গীতার অনুবাদক পরলোকগত কালিপ্রসন্ন ঘোষ মহাশয় তখনও জীবিত। তাঁকে যাইয়া ধরিলাম পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ লিখিয়া দিতে। তিনি বেদ-বেদান্ত বহু প্রাচীন শাস্ত্র হইতে উদ্ধৃতি দিয়া ‘ঊষা’ নামে একটি গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিয়া দিলেন। আমাদের উৎসাহ ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আমার নায়ের মাঝি নায়ের মাঝে, এখনো কেন শুয়ে? বেয়ে চল্ তোর না খানি ভাই, পাল তুলিয়া দিয়ে।
‘শুয়ে’ শব্দের সঙ্গে ‘দিয়ে’ শব্দের মিল যে একালের কবিতায় চলে না সে-জ্ঞান আমার তখনও হয় নাই। আমার কবিতা পড়িয়া যাঁহারা আমাকে উৎসাহ দিতেন তাঁহাদেরও এ-জ্ঞান ছিল না।
পত্রিকার পাণ্ডুলিপি তো তৈরি হইল। এখন উহা ছাপাইবার খরচ কে দিবে? প্রথম সংখ্যা ছাপাইতে প্রায় পঞ্চাশ টাকা ব্যয় হইবে। প্রথম সংখ্যা ছাপাইলেই অনুরোধ-উপরোধ করিয়া বহু গ্রাহক করা যাইবে। গ্রাহকদের দেয় চাঁদার টাকা হইতেই পরবর্তী সংখ্যাগুলি ছাপানো যাইবে। কথা হইল, স্থানীয় জমিদার চৌধুরীদের সঙ্গে দেখা করিয়া মোটারকমের কিছু চাঁদা আদায় করা হইবে। সেই টাকা দিয়া পত্রিকার প্রথম সংখ্যার ছাপার খরচ পোষানো হইবে। সেই বালক-বয়সের কল্পনার কাছে কোনো সমস্যাই হার মানিতে চাহে না। কিন্তু তারপর যে কেন আর পত্রিকা ছাপানোর কাজে অগ্রসর হওয়া গেল না, আজ তাহা ভালো করিয়া মনে পড়িতেছে না। হয়তো মনাদা পুলিশের চাকরি লইয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন অথবা কিছুদিন অতিউৎসাহের সহিত কাজ করিয়া মনাদা শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন; এমনই কোনো কারণে পত্রিকা ছাপানোর কাজ আর অগ্রসর হইল না। তখন আমি বারবার নিজেকে ধিক্কার দিতেছিলাম, জীবনের প্রথম চেষ্টাই যখন ব্যর্থ হইয়া গেল, আমার জীবনে কোনোদিনই কোনো পত্রিকা ছাপানোর কাজ সম্পন্ন করিতে পারিব না। সেই ভবিষ্যদ্বাণী বোধহয় আমার জীবনে সত্য হইতে চলিল।
শ্রীশবাবুর বাসায় থাকিতেন কালীমোহন নামে একটি কলেজের ছাত্র। বাসায় ছোট ছোট ছেলেদের পড়াইতেন। একদিন আলাপ-আলোচনা করিতে তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা বলিলেন। সেইসঙ্গে তিনি কংগ্রেসের কথাও পাড়িলেন। তৎকালে মুসলিম বক্তাদের বক্তৃতায় যেরূপ শুনিতাম তাহারই সুরে সুর মিলাইয়া আমি বলিলাম, “এখন স্বাধীনতা পাইলে উহা হিন্দুদের স্বাধীনতা হইবে। আগে আমরা মুসলমানেরা শিক্ষায়-দীক্ষায় হিন্দুদের সমকক্ষ হইয়া লই তখন আমরা স্বাধীনতার লড়াই করিব।”
কালীমোহনবাবু তখন আমাকে বলিলেন, “স্বাধীনতা মানে দেশের সকল লোকের স্বাধীনতা। দেশের যা কিছু সম্পদ, তাহা এখন বিলাত চলিয়া যায়। বিলাতের লোকেরা তাহা দিয়া সুখে-স্বাচ্ছন্দে ভোগবিলাস করে। স্বাধীনতা হইলে এই সম্পদ দেশের জনগণ উপভোগ করিবে।” আমি বলিলাম, “তাহা যদি সত্য হয় তবে মুসলমানেরা কংগ্রেসে যোগদান করে না কেন?” তিনি বলিলেন, “কে বলে মুসলমানেরা কংগ্রেসে নেই? ফজলুল হক, আলী ইমাম, মিঃ রসুল, মিঃ জিন্নাহ প্রভৃতি আরও বহু মুসলমান কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন।”
সেইদিন হইতে তিনি আমাকে খবরের কাগজ পড়িতে উৎসাহ দিতে লাগিলেন। দৈনিক বসুমতি তখন সবচাইতে বেশি চলিত। সেই কাগজে তখন বি বি বেসান্ত ও কংগ্রেস লইয়া বহু আলোচনা থাকিত। মাঝে মাঝে ফজলুল হক ও মিঃ রসুলের বক্তৃতা বাহির হইত। সেইগুলি তিনি বিশেষ করিয়া আমাকে পড়িয়া শুনাইতেন। ধীরে ধীরে আমার মন কংগ্রেসের প্রতি আকৃষ্ট হইতে লাগিল।
কালীমোহনবাবু বিপ্লবী দলের সভ্য ছিলেন। তিনি বিপ্লবী দলের গোপন লাইব্রেরি হইতে মাঝে মাঝে বই-পুস্তক আনিয়া আমাকে পড়িতে দিতেন। সখারাম গণেশ দেউস্করের দেশের কথা, বিনয় সরকারের সাধনা, নিগ্রোজাতির কর্মবীর ও অন্যান্য লেখকের জালিয়াত ক্লাইভ, রাজা প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি পুস্তক আনিয়া আমাকে পড়িতে দিতেন। এইসব বই সবটা পড়িয়া বুঝিতাম না। কিন্তু দেশের জনসাধারণের প্রতি একটি মমতাবোধ আমার মনে জাগ্রত হইত।
ইহার পর জানিতে পারিলাম, ধীরেনের বড় ভাই কিরণদাদা, যিনি আমাকে লইয়া ছাদে ধর্ম-সাধনা করিতেন, পরে রামকৃষ্ণ আশ্রমে যোগ দিয়াছিলেন, তিনিও বিপ্লবীদের সভ্য ছিলেন। এমনকি আমার বন্ধু ধীরেনও পরে বিপ্লবীদলের সভ্য হইল। মাঝে মাঝে তাহাদের গোপন সভা বসিত। সেই সভায় ধীরেনকে নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিয়া পড়িতে হইত। সেই প্রবন্ধের অধিকাংশই আমি লিখিয়া দিতাম। ধীরেন আসিয়া গল্প করিত, তাহার প্রবন্ধ শুনিয়া বিপ্লবীদলে তাহার খুব সুখ্যাতি হইয়াছে। এই বিপ্লবীদলের অনেককেই আমি চিনিতাম। তাহারা বুকটান করিয়া বুকের সিনা উঁচু করিয়া চলিত। স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার জন্য ডন-কুস্তি করিত। আমিও তাহাদের দলের সভ্য হইতে চাহিতাম। আমি মুসলমান আর আমার বড় ভাই পুলিশের চাকরি করিতেন বলিয়া তাঁহারা বিশ্বাস করিয়া আমাকে দলে লইতেন না। স্কুলের একদল ছাত্র এই দলের সভ্যদিগকে মরালিস্ট বলিয়া খেপাইত।