বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশে যান?  

  • Update Time : শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫, ৬.২০ পিএম

সারাক্ষণ রিপোর্ট

পাঁচ বছর আগে, ৮ মার্চ, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) প্রথম তিনজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেয়। এর দশ দিন পর প্রথম আনুষ্ঠানিক মৃত্যু রিপোর্ট করা হয়। এরপর লকডাউন, হাসপাতালের সংকট, অক্সিজেনের ঘাটতি এবং খাদ্য সংকটের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। সরকারি হাসপাতালগুলো রোগীতে উপচে পড়ে, আর বেসরকারি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত ফি নিতে শুরু করে। পাশাপাশি, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার নগ্ন চিত্রের পাশাপাশি কিছু ফ্রন্টলাইন যোদ্ধার নিঃস্বার্থ সেবাও দেখা গেছে।

স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থার হ্রাস

মহামারির অভিজ্ঞতা দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর দুর্বলতা স্পষ্ট করেছে। এটি পরিবর্তনের সুযোগ হতে পারত, কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থা আরও কমে গেছে। ২০২৩ সালে, আগের বছরের তুলনায় ৪৮% বেশি বাংলাদেশি রোগী বিদেশে চিকিৎসা নিতে গেছেন। প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা করাতে যান, যার ফলে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। ধনী ব্যক্তিরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে যান, আর আর্থিকভাবে দুর্বলরা ভারতের মতো দেশে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হন। ভারতের প্রখ্যাত ডাক্তার দেবী শেঠি সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে সেই রোগীরা এখানে আসেন যাদের নিজ দেশে উচ্চ খরচে চিকিতসা করানোর সমর্থ নেই। তারা কম খরচের জন্যে ভারতে আসেন।

বিদেশে চিকিৎসার প্রবণতা ও কারণ

বিদেশে চিকিৎসার চাহিদা বাড়ার পেছনে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যর্থতা অন্যতম কারণ। ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের হাসপাতালগুলো বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে, যেমন দোভাষী ও সহায়তা ডেস্ক। স্থানীয় এজেন্টরা রোগীদের নির্দিষ্ট হাসপাতালে পাঠান, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসার মানের জন্য নয়, বরং কমিশনের ভিত্তিতে করা হয়। কিছু বাংলাদেশি হাসপাতালও এজেন্টদের মাধ্যমে রোগী বিদেশে পাঠিয়ে রেফারেল ফি পায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা

প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা বিপুল অর্থ দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারত। তবে এখনো সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। কিছু দেশ বাংলাদেশি রোগীদের ওপর নির্ভরতা কাজে লাগিয়ে তাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর নিয়মাবলী অনেক রোগীর চিকিৎসার সুযোগ সীমিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার চীনের কুনমিং এবং মালয়েশিয়াকে বিকল্প চিকিৎসা গন্তব্য হিসেবে প্রচার করছে, তবে এক দেশের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আরেক দেশে নির্ভরতা বাড়ানো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তাছাড়া কুনমিং ও মালয়েশিয়া দরিদ্র রোগীকে কোন সাহায্য করেবে না।

দেশীয় চিকিৎসকদের দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং বিশ্বমানের হাসপাতালগুলোতে কাজ করছেন। কিন্তু যারা দেশে রয়েছেন, তারা দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাবজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। রাজনৈতিকীকরণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং দুর্নীতির কারণে চিকিৎসকদের পেশাদারিত্ব ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে অসাধু চুক্তি, যেখানে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়, সেটিও একটি বড় সমস্যা।

চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের অবনতি

স্বাস্থ্যসেবার প্রতি অবিশ্বাসের কারণে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। রোগীর পরিবারের হতাশা ডাক্তারদের প্রতি ক্ষোভে রূপ নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা রোগীর পরিবারের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, যা স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আরও দুর্বল করছে। চিকিৎসকরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, আর রোগীর পরিবাররা চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে সন্দিহান।

নেতৃত্বের ভূমিকা ও দায়িত্ব

দেশের নেতারা যখন নিজেরাই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান, তখন সাধারণ মানুষের আস্থা আরও কমে যায়। রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ীরা যখন স্থানীয় হাসপাতালের পরিবর্তে বিদেশে যান, তখন জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে—এ দেশে কি আদৌ মানসম্মত চিকিৎসা সম্ভব? সরকার যদি দেশীয় স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করতে চায়, তবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সবার জন্য সমান মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করা দরকার।

উপসংহার

বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর, যা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই প্রবণতা রোধ করতে হলে দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল সংস্কার এবং আস্থার পুনঃস্থাপন অত্যন্ত জরুরি। যদি জনগণ স্থানীয় হাসপাতালগুলোর প্রতি আস্থা না পায়, তবে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। এখন সময় এসেছে, স্বাস্থ্যসেবাকে সত্যিকারের সবার জন্য সমান ও উন্নত করা।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024