সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- গত ২৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়ও (WHO) চীনের ভূমিকা সীমিত এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত
- যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার ফলে চীন তাদের স্থান দখল করবে না, বরং বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি হবে
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব স্বাস্থ্য উদ্যোগ থেকে সরে আসার কারণে অনেকেই মনে করছেন, চীন এই শূন্যতা পূরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা দখল করবে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয় বরং আরও ভয়াবহ। চীন কিছু ক্ষেত্রে তৎপর হলেও, বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নেতৃত্ব নেবে না। ফলে বিশ্বব্যাপী এক বিশাল স্বাস্থ্য সঙ্কটের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়া স্বাস্থ্য কাঠামো
গত ২৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল, কূটনৈতিক প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিশ্ব স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০২৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্র তার মোট বাজেটের মাত্র ০.৩ শতাংশ (২০.৬ বিলিয়ন ডলার) স্বাস্থ্য সহায়তায় ব্যয় করলেও, এর প্রভাব ছিল বিশ্বজুড়ে বিশাল:
- এইচআইভি/এইডস সহায়তায় ৭৫% আন্তর্জাতিক তহবিল এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে
- ম্যালেরিয়ায় ৪০% এবং যক্ষ্মায় এক-তৃতীয়াংশ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
- কোভিড ভ্যাকসিন ও মহামারি প্রতিরোধেও নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কী ধরনের অগ্রগতি হয়েছে?
- এইডস মৃত্যু: ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এইডসে মৃত্যুর হার ৫০% কমেছে
- যক্ষা ও ম্যালেরিয়া মৃত্যু: এক-তৃতীয়াংশ কমেছে
- শিশু মৃত্যুর হার: ২০০০ সালে ৪২টি দেশে প্রতি ১০ শিশুর ১ জন মারা যেত, এখন এই সংখ্যা মাত্র ৪টি দেশে
- ২১ মিলিয়ন মানুষ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের PEPFAR প্রোগ্রামের ওপর নির্ভরশীল
- ৭০ মিলিয়ন শিশু প্রতিবছর ভ্যাকসিন পায় Gavi-এর মাধ্যমে
চীনের পদক্ষেপ: প্রভাব বিস্তার, কিন্তু সীমিত অবদান
চীন বিভিন্ন দেশে (যেমন: নেপাল, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ) স্বাস্থ্য সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এর ব্যাপ্তি সীমিত:
- চীনের অগ্রাধিকার: বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ অংশীদারদের প্রতি বেশি মনোযোগ
- Gavi-তে চীনের অনুদান: ১০ বছরে মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে ২ বিলিয়ন
- Global Fund অনুদান: চীন দিয়েছে ৯০ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে ২৬ বিলিয়ন
- WHO তে সম্পর্ক: চীন সদস্য হলেও বহুপাক্ষিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বা গরিব দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেয় না
- কোভিড সহায়তা: চীনের সহায়তা প্রধানত প্রতিবেশী এবং কৌশলগত অংশীদারদের জন্য, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নয়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাথে জটিল সম্পর্ক
- ২০০৩ সালের SARS মহামারি: চীনের স্বচ্ছতার অভাবে WHO তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে
- COVID-19: চীনের চাপের কারণে WHO দেরিতে মহামারি ঘোষণা করে
- চীনের প্রভাব: WHO থেকে তাইওয়ানকে বাদ, চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা অন্তর্ভুক্তি
- তিক্ততা: পরবর্তীতে WHO চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, ফলে সম্পর্ক আবার টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে
কেন চীন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা পূরণ করতে পারবে না?
- স্বল্প বহুপাক্ষিক অনুদান: চীন বেশি অনুদান দেয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে
- কম স্বাস্থ্য সহায়তা বাজেট: মহামারি-পূর্ব চীনের স্বাস্থ্য সহায়তা ছিল ৬০০–৮০০ মিলিয়ন ডলার, মাত্র ১০% গিয়েছিল বহুপাক্ষিক সংস্থায়
- আফ্রিকায় আগের তুলনায় কম গুরুত্ব: ১৫ বছর আগে শীর্ষ ৫ প্রাপক দেশের ৪টি ছিল আফ্রিকান, এখন মাত্র ১টি
- জাতীয় স্বার্থ আগে: মহামারি এবং গবেষণায় চীন বেশি আগ্রহী যেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ জড়িত
সংকট সামনে: বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে
- যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হলে গঠিত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য কাঠামো ভেঙে পড়বে
- অন্য দাতারা টানাপোড়েনে: যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এমনকি গেটস ফাউন্ডেশনও পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে পারবে না
- চীনও পিছিয়ে: অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে চীন বিদেশি সাহায্যে কম মনোযোগ দেবে
বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশ বছরে মাথাপিছু মাত্র ৯২ ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি পুরোপুরি পিছু হটে, তাহলে বেশিরভাগ স্থানে কেউই সেই শূন্যতা পূরণ করবে না।
শেষ কথা: শূন্যতার সুযোগে চীন নয়, আসবে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয়
যদি যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্ব স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়ায়, তাহলে চীন তা পূরণ করবে না—এবং এই ফাঁকই তৈরি করবে এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের। কিছু নির্দিষ্ট সহায়তা টিকে থাকলেও, বিশাল আকারে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়ার কাঠামো ভেঙে যাবে। ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সময় আমরা সেটা বুঝতে পারবো তখনই, যখন খুব দেরি হয়ে যাবে।