সারাক্ষণ রিপোর্ট
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস এবং ব্যাংক যখন ঈদ উপলক্ষে প্রায় নয় দিন বন্ধ থাকে, তখন হাসপাতালগুলোর পক্ষে এত দীর্ঘ ছুটি পালন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু দীর্ঘ ছুটিতে রোগীদের সেবা ঠিকভাবে পাওয়া যায় কি না, বা হাসপাতালে চিকিৎসা-ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকে কি না, এ নিয়ে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা অনেকেরই রয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থা
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের ছুটিতেও বেশিরভাগ হাসপাতালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী ভর্তি আছেন। সিনিয়র কনসালট্যান্টদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও মেডিকেল অফিসার ও জুনিয়র চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করছেন। নার্স ও ওয়ার্ড বয়রাও নিয়মিত সেবা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঈদের সময়েও প্রায় ৫০০ রোগী ভর্তি রয়েছেন। যাদের শারীরিক অবস্থা এখনও গুরুতর, তারা ছুটি পেয়ে বাড়ি যেতে পারছেন না। সিনিয়র চিকিৎসকরা ঈদের সময় নিয়মিত আসবেন কি না—এই চিন্তায় অনেক রোগী ও স্বজন উদ্বিগ্ন।
• একজন ভর্তিকৃত রোগী আহাদ মিয়া (৬০), পেশায় দিনমজুর, হবিগঞ্জ থেকে এসেছেন কিডনিতে পাথরজনিত সমস্যায়। চিকিৎসকরা তার কিডনিতে ওয়াশিং করেছেন, তবে কিছু পাথর এখনও রয়ে গেছে। তিনি জানান, “ডাক্তার আমাকে ঈদের ছুটিতেও হাসপাতালে থাকতে বলেছেন। এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি পড়েনি। ডাক্তাররা নিয়মিত আসছেন, কিন্তু সামনে কী হবে সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।”
• আরেকজন রোগী, বাগেরহাটের সফেদ হাওলাদার (৭২), মূত্রথলিতে টিউমার নিয়ে ২০ দিন ধরে ভর্তি। তার মেয়ে পারভীন আক্তার (৪০) বলেন, “ছুটিতেও আমাদের ভালো সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে সিনিয়র ডাক্তার না থাকায় অপারেশন ঈদের পর হতে পারে। তবু তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে।”
• সিনিয়র স্টাফ নার্স সাধনা হালদার জানালেন, “ঈদের ছুটিতে কিছুটা কম সংখ্যক ডাক্তার-নার্স থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এটিকে ভাবা উচিত নয় যে হাসপাতাল ফাঁকা হয়ে যাবে। জরুরি প্রয়োজনে ডিউটির বাইরে থাকা ডাক্তারকেও ফোনে পাওয়া যায়। তাছাড়া ঈদের দিন মুসলিম সহকর্মীরা নামাজ ও দুপুরের সময়ে ছুটি পেলেও অমুসলিম ডাক্তার-নার্সরা দায়িত্বে থাকেন।”
• আরেকজন সিনিয়র স্টাফ নার্স বিউটি গোমেজ জানালেন, “অনেক রোগী নিজেই ঈদের আগে বাসায় যেতে চান। কিন্তু যাদের অবস্থা গুরুতর, তাদের রাখা হয়। ইনজেকশন, ড্রেসিং বা ওষুধ দেওয়ার মতো কাজের জন্য সব সময় সিনিয়র ডাক্তার লাগেই না; নার্স আর মেডিকেল অফিসাররাও এসব দক্ষতার সঙ্গে সামলে নেন।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও প্রায় একই চিত্র। জরুরি বিভাগে ডাক্তাররা সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকলেও ওয়ার্ডে সিনিয়র কনসালট্যান্টদের সংখ্যা তুলনামূলক কম।
• ভর্তি রোগীর স্ত্রী শিল্পী খাতুন (৪৫) বলেন, “ডাক্তাররা আসছেন, চিকিৎসাও দিচ্ছেন। কিন্তু সিনিয়র ডাক্তার ঈদের সময় নাও থাকতে পারেন, এটা ভাবলে একটু চিন্তা হয়।”
• গোপালগঞ্জের আরেক রোগীর স্বজন মিশকাত (২৮) বললেন, “সেবা ঠিকই পাচ্ছি, তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় না। শুনেছি, ঈদের ছুটিতে সরকারি হাসপাতালের সেবা অনেক সময় বেসরকারি হাসপাতালের চেয়েও ভালো থাকে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা
হাসপাতালগুলোতে জরুরি চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে জরুরি বিভাগ, লেবার রুম, অপারেশন থিয়েটার ও ল্যাবরেটরিতে পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, কর্মীদের ঈদের ছুটি এমনভাবে ভাগ করা হয়েছে যাতে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ঈদের আগের দিন, ঈদের দিন এবং পরদিন—এই তিন দিন আউটডোর সেবা বন্ধ থাকবে। তবে যেকোনো রোগী এ সময় এলে জরুরি বিভাগে গিয়ে সেবা নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল হক বলেন, “আউটডোর বন্ধ থাকলেও রোগী ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। ঈদের দিন অমুসলিম চিকিৎসকরা বেশি সময় দায়িত্বে থাকেন। ছুটি হলেও রোগী সেবায় কোনো বিশৃঙ্খলা হতে দেওয়া হয় না।”
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বেসরকারি হাসপাতাল সংক্রান্ত অভিযোগ
বেসরকারি হাসপাতাল সাধারণত উন্নত সেবার আশ্বাস দিলেও ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন সমস্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, সেখানকার ল্যাবরেটরি বন্ধ, নার্সের অভাব বা রোগীদের জোর করে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
• সাব্বির হোসেন (৩৭) আগের বছরের একটি অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, “গতবার ঈদের দিন অসুস্থ হয়ে জরুরি পরীক্ষার প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঘুরেও পরীক্ষা করাতে পারিনি। পরে ব্যক্তিগত যোগাযোগ দিয়ে শেষমেশ পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।”
• এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. খান রাওয়াত বলেন, “ঈদের ছুটিতে অনেক রোগী বাড়ি যেতে চান। গুরুতর অবস্থা না হলে আমরা তাদের অনুরোধে ছাড়ার ব্যবস্থা করি। এটা ঠিক যে বেশিরভাগ মানুষ ঈদে পরিবারের সঙ্গে থাকতে চান। কিন্তু জরুরি কোনো পরিস্থিতি হলে সিনিয়র ডাক্তারদের ফোন করলেই তারা চলে আসেন, বা নির্দেশ দেন। তাই সেবায় বড় কোনো ঘাটতি হয় না।”
ইদের খাবারের ব্যবস্থাপনা
ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে রোগীদের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়। সাধারণত সকালের নাশতায় সেমাই, রুটি, কলা, দুধ, ডিম ও বিস্কুট দেওয়া হয়। দুপুরে থাকে পোলাও, চিকেন রোস্ট, রেজালা, ডিমের কারি ও সফট ড্রিঙ্ক, কোনো কোনো হাসপাতালে আপেল বা কমলা-লেবুও দেওয়া হয়। রাতে সাধারণত ভাত, ডাল ও সবজি পরিবেশন করা হয়।
উপসংহার
সব আয়োজন সত্ত্বেও কেউই সত্যিকারে চাইবেন না ঈদের দিন হাসপাতালে কাটাতে। তবু যাদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তাদের মূল প্রত্যাশাই থাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ও যত্ন। অনেক মানুষের শহর ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তেও যারা হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করেন—তাদের কর্মপ্রচেষ্টায় এই দীর্ঘ ছুটিতেও রোগীরা চিকিৎসা পেয়ে থাকেন।
(ইউএনবি ইংরেজি থেকে অনূদিত, সারাক্ষনের নিউজ ফরমাট অনুযায়ী উপস্থাপিত)