স্বদেশ রায়
মুহাম্মদ ইউনূস ও শ্রী নরেন্দ্র মোদি’র সাইড লাইন বৈঠকটার চরিত্র দেখে বোঝা যায়, ভারত এখানে ডিপ্লোম্যাটিক টেনশনে ঝুলিয়ে রেখেছিল- যার চরিত্র ছিল “অনিশ্চয়তা” । তারপরেও মুহাম্মদ ইউনূস অন্তত একটি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। যা এ মুহূর্তে তার জন্য সব থেকে জরুরী। সেটা হল, তার “রিসেট বাটন”, “ জুলাই বিপ্লব” “ মাস্টারমাইন্ড পরিকল্পিত সাফল্য” এগুলো থেকে বের হয়ে আসার একটা পথ খোঁজা। এবং এই পথটি তার খোঁজার একান্ত দরকার ছিল। কারণ, আমেরিকাতে বাইডেন প্রশাসনের শুধু অবসান হয়নি, তাদের সিস্টেমটাই বদলে যেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ “ইউএসএইউ পেইড” জঙ্গীবাদের ওপর বিপ্লবের নামে আন্তর্জাতিকভাবে একটা গণতান্ত্রিক কাভারেজ দেয়ার খেলাটি পৃথিবীতে আপাতত বন্ধের দিকে যাচ্ছে।
অন্যদিকে যে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনার পতন হয়েছিল ওই আন্দোলনকে আর যাই হোক কোন মতেই গণ-অভ্যুত্থানে ধরে রাখা যায়নি। দেশের সমগ্র মিডিয়া কন্ট্রোল করলেও এর ভিন্ন বাস্তবতা দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ, শেখ হাসিনার পতনের পর পরই একের পর এক ঢাকার রাজপথে “মার্চ ফর খেলাফত” হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশের দেয়ালগুলো “মার্চ ফর খেলাফতের” পোস্টারে ভরে গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ১৯৫৫ এর পরে সব থেকে বেশি নির্যাতন চলছে এখন। এর বিপরীতে যতই যুক্তি দেয়া হোক না কেন, “ ভারতে দাঙ্গা” হয়। দাঙ্গা হয় তখন, যখন দুইপক্ষের শক্তি থাকে। তখন তারা একে অপরের সঙ্গে দাঙ্গা করলেও সংখ্যালঘুরা সেখানেই টিকে থাকে। কিন্তু ক্লিনজিং বা পারসিকুয়েশান হয় তখনই যখন সংখ্যালঘুরা একেবারে শক্তিহীন হয়ে যায়। আর এই শক্তিহীন হবার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় সরকার যখন ওই পারসিকুয়েশান বা ক্লিনজিংকে অস্বীকার করে। সরকার অস্বীকার করলেই প্রশাসন সিগন্যাল পেয়ে যায়। আর ক্লিনজিং-এর বিষয়টি এতই নীরবে ঘটে এবং তার চরিত্র এতই বহুমুখী যা কোন মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়ে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়। যে কোন দেশের সংখ্যালঘুরা আসলে এতই অসহায় যে বাস্তবে পৃথিবীতে তাদের কোন বন্ধু নেই।
তাছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য এখন সব থেকে বড় বিপদ হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী যে রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে যেখানে বাঙালি হিন্দু আছে সেখানকার রাজ্য-সরকার প্রধান ৪৭ পরবর্তী রাজ্য সরকার বা ৭১ এর রাজ্য সরকারের মতো বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রতি মমতাশীল নয়। বরং তিনি ক্ষমতার রাজনীতি করেন। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বামশক্তি তামিলনাড়ুর বামশক্তির মতো মানবতাবাদী ও শিক্ষিত নয়। এদের বেশিভাগই একটি মাছের মাথা পঁচে গেলে যেমন গন্ধ হয় তেমনি একটি পঁচা মাথার দুর্গন্ধময় শ্রেণী। তাই তামিলনাড়ুর বামশক্তি যেমন শ্রীলংকার তামিল হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল , পশ্চিমবঙ্গের বামদের সেই মানবিকতা নেই। যেমন সব সময়ই শ্রীলংকার তামিল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হলেই তামিলনাড়ু’র মানুষ এককাট্টা হয়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের নিরাপদে ভারতে নিয়ে আসার বা বর্ডার ওপেন করে দেয়ার জন্যে, পশ্চিমবঙ্গে অতীতে তা ঘটলেও বর্তমানে তা অনেকখানি বিপরীতে। অথচ মুহাম্মদ ইউনূসের “মাস্টারমাইন্ড” উপদেষ্টা তার ভাষায় দেশকে ১৯৪৭ এর “বন্দোবস্ত”য় নিয়ে যেতে চায়।
বাংলাদেশকে যে সময় তাদের ভাষায় ১৯৪৭ এর বন্দোবস্ত -এ নিয়ে যাবার কথা বলছে তারা- সে সময়ে বাংলাদেশের হিন্দু তরুণরা কিন্তু এই দেশ ও মাটিকে ভালোবেসে, এই দেশে নিজের অধিকারের জন্য চিম্ময় প্রভূর নেতৃত্বে রাজপথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলো। তাদের সেই নিজ দেশে থাকার অধিকারটুকু চাওয়ার আন্দোলনও চিম্ময় প্রভূ’র নামে ঠুনকো কারণে বিশাল অভিযোগ দিয়ে তাকে কারা প্রকোষ্ঠে নিয়ে, তার সহযোগীদের রাজপথে কুপিয়ে আহত করে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে -সেই তরুণদের এখন মানসিকভাবে মৃতপ্রায় শুধু করা হয়নি; তাদের এ দেশ ঘিরে আশা আকাঙ্খাও স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাস্তবে এদেশের তরুণ হিন্দু প্রজম্মকে যে অবস্থানে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তাতে তাদের সামনে স্বাভাবিকভাবেই ইন্দিরা- মুজিব চুক্তি বাতিল ও নেহেরু- লিয়াকত প্যাক্ট রিভাইব করার দাবি সামনে চলে আসে।
শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপর এই নির্যাতন নয়, এছাড়া পুলিশ হত্যায় ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে। অথচ সন্ত্রাসীরা টেলিভিশনের পর্দায় গিয়ে স্বীকার করেছে তারা পুলিশ হত্যা করেছে। এর পাশাপাশি নারী, অন্যান্য উদার মুসলিম সম্প্রদায় ও সর্বোপরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বুদ্ধিজীবিদের স্তব্ধ রাখা হয়েছে- ভীতির সংস্কৃতি চালু করে, তাদের ওপর হামলা করে। যার একটি মোটামুটি চিত্র ফুটে ওঠে ইউনূস- মোদি সাইড লাইন বৈঠকের আগের দিন “নিউ ইয়র্ক টাইমসের” প্রিণ্ট ভার্সানের লিড নিউজে। যা ওই পত্রিকায় দুই দিন আগে তাদের অনলাইন ভার্সানে ছাপা হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস নতুন কিছু ছাপেনি। এর আগে বিবিসি সহ অনেক বড় বড় মিডিয়া এ নিউজগুলো নানাভাবে ছেপেছে। তারপরেও ডেমোক্র্যাট সমর্থিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের মত একটি লেগাসি মিডিয়া যখন এটা প্রচার করে তখন মুহাম্মদ ইউনূসের মত বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুঝতে কষ্ট হয় না যে, “ রিসেট বাটন” আর তার মাস্টার মাইন্ডের মেটিক্যুলাস ডিজাইনের “ জুলাই বিপ্লব” এর বাস্তবতা।
আর এই বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি মোদি’র সঙ্গে তার সাইড লাইন বৈঠক শেষে তিনি কিন্তু তার ওই জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতির বই মোদিকে উপহার দিলেন না। তার বদলে মোদি তাকে যে একবার পুরস্কৃত করেছিলেন সেই পুরস্কার গ্রহনের ছবিটি চমৎকার বাঁধাই সম্বলিতভাবে মোদিকে উপহার দিলেন। এবং মোদির সঙ্গে আলোচনায় তিনি তার জুলাই বিপ্লবের কথা একবারও উল্লেখ করেননি, বরং বার বারই ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সেখানে ভারতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এর ভেতর দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস কী ইঙ্গিত দিলেন তা নিশ্চয়ই কারো ব্যাখা করার প্রয়োজন পড়ে না।
মুহাম্মদ ইউনূসকে এই সত্য স্বীকার করার জন্য বিএনপি, সিপিবি’র মতো পুরানো রাজনৈতিক দলগুলো বার বার বলে আসছে। তারা একথাও বলছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতন অর্থাৎ এই নয়, শেখ হাসিনা যে জঙ্গীদের সাজা দিয়েছিলেন তাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে। তাদের বিচার বন্ধ করতে হবে। এমনকি বিচার করতে হবে, যারা পুলিশ হত্যা করেছে, সংখ্যালঘু সহ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে তাদের।
তাছাড়া মুহাম্মদ ইউনূস যখন তার সেই গ্রাফিতির বইকে পাশে ফেলে শুধু তার নিজেকে সামনে নিয়ে এলেন, সে সময়ে তার নিয়োগকর্তা ছাত্রদের চরিত্রও দেশবাসী দেখে ফেলেছে। কারণ, বাংলাদেশে ৬৯ হয়েছে, ৯০ হয়েছে। ৬৯ ও ৯০ এর পরে ছাত্র নেতাদের চরিত্র ও তাদের দেশের জন্য অবদান এ দেশের মানুষ জানে। তার বদলে যে ছাত্রদের মুহাম্মদ ইউনূস তার নিয়োগকর্তা বলেছিলেন, তাদের চরিত্র এই সাতমাসে দেশের মানুষ দেখেছে। যারা আগে নিজমুখে বলেছে, তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকার কোন ভালো ঘর নেই। যারা বলেছে, তাদের মানিব্যাগ নেই। এমনকি তারা কী খেত আগে- সে ছবিও মানুষ দেখেছে। তারা এখন সবাই কোটি টাকার ওপরের দামের গাড়ি চড়ে, চল্লিশ লাখ টাকা দামের ঘড়ি পরে। ওবায়দুল কাদেরের জীবনযাত্রায় চলে গেছে তারা সাত মাসেই। এর পরে এদেরকে নিয়ে কোন স্বপ্ন পাগলেও দেখে না।
শুধু এখানেই শেষ নয়, দেশের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সেনাবাহিনী। সত্যি অর্থে যে সুশৃঙ্খল বাহিনীটির জন্য এখনও দেশটি টিকে আছে। কারণ, পুলিশ হত্যা করে, সিভিল প্রশাসনে ঢালাওভাবে ওএসডি করে, সুপ্রীমকোর্টে মব ঢুকিয়ে, সাংবাদিকদের নামে মিথ্যে মামলা ও অপবাদ দিয়ে, ওই তথাকথিত ছাত্র নেতাদের ঈশারায় অসংখ্য সাংবাদিককে চাকুরিচ্যূত করে, এমনকি সংবাদপত্র অফিসের সামনে জঙ্গী মহড়া দিয়ে -মূলত রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রিপলড করা হয়েছে। এ সময়ে দেশকে টিকিয়ে রেখেছে একমাত্র সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে প্রকাশ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগকর্তারা যে ভাষায় কথা বলেছে, তা নিয়ে যে কোন দেশপ্রেমিক মানুষের শুধু মাথা নীচু হবে। ওই তথাকথিত ছাত্রদের নিয়ে কেউ আর স্বপ্ন দেখবে না। আর মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বুদ্ধিমান লোকের তো প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু এর পাশাপাশি আরেকটি সত্য এখন দেশ প্রেমিক সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধভাবে চিন্তা করার সময় এসে গেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যার অর্থনৈতিক অগ্রগতি গত পনের বছরে ছিলো ঈর্ষনীয়। দেশটি ২০২৬ এ মধ্য আয়ের দেশ হবে। এই দেশটি আর কতদিন সাইড লাইন বৈঠকে , বেসরকারী প্রোগ্রামে যোগ দিয়ে কোনমতে সে দেশের সরকারের সঙ্গে একটু দেখা করার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে? এই দেশ স্বাধীন হবার পরে অনেকগুলো নির্বাচিত সরকার, রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে দুটো শক্তিশালী সামরিক সরকারও এ দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু কখনই দেশটি সাইড লাইনে ছিলো না। একটি দেশ সাইড লাইনে থাকা সত্যই তার জাতির জন্য অবমাননাকর। তাই যত দ্রুত হোক বর্তমানের এই সাইড লাইন অবস্থা থেকে বের হয়ে এসে শক্তিশালী সরকার ও তাদের মাধ্যমে ইনক্লুসিভ ইলেকশান অনুষ্ঠিত করে দেশকে তার আপন গতিতে চলার ট্রেনে তুলতে হবে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রথীন্দ্রনাথ রায় উদাত্ত গলায় গাইতেন “ আমারই দেশ, সব মানুষের”।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.