বড়ু
ইহারও বহুদিন পরে। তখন আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ি। যখনই আমি দেশে আসিতাম গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে যাইতাম। সেবার যাইয়া দেখি রহিম মল্লিকের মেয়ে বস্তু দেখিতে কি সুন্দর হইয়াছে। কতবার তো এই বাড়িতে আসিয়াছি। কোনোদিনই তো এই মেয়েটি আমার চোখে পড়ে নাই। বয়স তাহার পনরো যোল হইবে। তার মার আর কি রূপ ছিল। মেয়ে যেন তাঁতিপাড়ার যত সুন্দর সুন্দর নতুন বুনট-করা শাড়ি তার সব রং গায়ে মাখিয়া আসিয়াছে। মুখের দিকে চাহিলে চোখ নামাইয়া লয়-যেন লজ্জাবতী লতাটি, গায়ে এতটুকু বাতাস লাগিলে পাতার দলগুলি গোটাইয়া লয়। ডুরে শাড়ি পরনে। তার রূপে যেন সমস্ত উঠান আলো হইয়া উঠিয়াছে।
এবার হইতে রহিম মল্লিকের মা, দাদির সঙ্গে আমার আরও অন্তরঙ্গতা বাড়িয়া উঠিল। দাদি এককালে ভালো বিয়ের গান গাহিতে পারিত। সেই গান খাতায় লিখিয়া লইতে ঘন ঘন দাদির সঙ্গে দেখা করিতে লাগিলাম। সব গানের পদ দাদির ভালো করিয়া মনে নাই। দাদি ডাক দেয়, “ও বড়ু এদিকে আয়, আমার সঙ্গে গানটি ধর। তোর ভাই শুনিতে চায়।”
এক গা ভরিয়া রূপ আর লজ্জা আড়াআড়ি করিয়া তাহার দেহকে ঘিরিয়া আছে। সহজে কি আসিতে চায়! অনেক ওজর-আপত্তি করিয়া নাতনি আসিয়া দাদির কাছে বসে। দাদির মোটা গলার সঙ্গে নাতনির সরু কণ্ঠ মিলিয়া গানের সুর বিস্তৃত হইতে থাকে। মেয়েলি গানে তেমন সুর-বৈচিত্র্য নাই কিন্তু সেই একঘেয়ে সুরের মধ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যে কারুকার্য আছে তাহা বুঝিবার মতো যাহাদের অভ্যস্ত কান আছে তাহারাই মাত্র বুঝিতে পারে। বড়ুর কণ্ঠে সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজগুলি এমনি করিয়া প্রকাশ পাইতেছিল যা শুধু অনুভব করিবার-বুঝাইয়া বলিবার নয়। দাদি আর বড়ু দুইজনে মিলিয়া গান গাহিয়া চলিল, গাঙের কুলে কলার গাছটি ও ভানুলো চিরল চিরল পাতা নারে। তারির না তলে তারির না তলে ও ভানুলো খেলায় রঙের পাশা নারে।
পাশা না খেলিতে পাশার বুঝান বুঝাইতে
ও ভানুলো ঘুমে চৈতন হৈল নারে।
ঘুমের ঢোলনি ঘুমের ভুলনি,
ও ভানুলো পাল্কিতে তুইলা দিলি নারে।
পাল্কির হেলনি-পাল্কির দোলনি
ও ভানুলো চৈতন ভালো হৈল নারে।
“এত যে আদরের এত যে দরদের
ও সাধুরে, মা ধন কোথায় রইল নারে।
“এত যে আদরের এত যে দরদের
ও সাধুরে, বাপজান কোথায় রইল নারে।”
“ও বাড়িতে নিয়া ঘরে না নিয়া
ও ভানুলো ভাঙব উফল গলা নারে।”
চলবে…..