মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ১০:৪০ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৭৫)

  • Update Time : বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫, ১১.০০ এএম

বড়ু

সেবার শুনিতে পাইলাম, বড়ুর হাতে গলায় যে কয়খানা সোনার গহনা তার বাপ তাহাকে বিবাহের আগে দিয়াছিল, তাহা চোরে লইয়া গিয়াছে। বড়ু বসিয়া কাঁদিতেছে। বস্তুকে কি আর সান্ত্বনা দিব। মেয়েরা গহনা ভালোবাসে তার কারণ গহনাগুলি তাহাদের দুর্দিনের সম্বল। অভাবের দিনে এই গহনাগুলি বেচিয়া জীবন ধারণ করা যায়। এগুলি লইয়া দরকার হইলে তাহারা স্বামীর অন্যায়ের সঙ্গেও যুদ্ধ করিতে পারে। আব্বাস তো তাহাকে আর গহনা কিনিয়া দিতে পারিবে না। বৃথা কয়েকটি সান্ত্বনার বাক্য বলিয়া চলিয়া আসিতেছিলাম, দাদি আমাকে হাত ইশারায় ডাক দিল। কাছে যাইতেই দাদি বলিল, “ভাইরে। দুঃখের কথা কাহাকে বলিব? এই গহনাগুলি আব্বাস নিজেই চুরি করিয়াছে। কোথায় যেন বিক্রি করিয়া আসিয়াছে। সেই টাকার কিছু দিয়া চাউল কিনিয়া আনিয়াছে, তরিতরকারি কিনিয়া আনিয়াছে। কিন্তু এই পোড়ারমুখী কিছুতেই একথা বিশ্বাস করিতে চাহে না। ও যদি সোয়ামিকে শাসানি দিত, তবে গহনাগুলি কি না বাহির করিয়া পারিত? কিন্তু ও তাকে কিছুই বলে না।” অনেক কথা ভাবিতে ভাবিতে গৃহে ফিরিয়া আসিলাম।

একবার বড়ুর সামান্য জ্বর। আব্বাস তার জন্য এক ফোঁটাও পথ্য কিনিয়া আনে নাই! আমি ঔষধ-পথ্যের জন্য কয়েকটি টাকা বড়ুর হাতে দিলাম। সে অতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমার দিকে তাকাইয়া টাকা কয়টি গ্রহণ করিল। আমি বড়ুকে বলিলাম, “বড়ু। আব্বাসের হাতে পড়িয়া তোমার কষ্টের অন্ত নাই। সে তোমাকে দুইবেলা ভালোমতো আহারও দিতে পারে না। ইচ্ছা করিলেই তুমি এই অভাবের বন্ধন কাটাইতে পার। তুমি যদি একটু আভাস দাও তোমাকে লইয়া গিয়া আমি রানীর হালে রাখিতে পারি।”

বড়ু কিছুই বলিল না। বালিশের তলা হইতে টাকা কয়টি অনেক কষ্টে খুঁজিয়া বাহির করিয়া বলিল, “ভাই। আমার টাকার কোনোই দরকার নাই। টাকা আপনি লইয়া যান।” বস্তুর এই সামান্য কথাগুলি আমার পিঠে যেন চাবুকের আঘাত করিল। অনেক মিনতি

করিয়া বলিলাম, “বস্তু। তুমি আমাকে মাফ কর। আমি তোমার দুঃখকষ্ট দেখিয়া সহ্য করিতে পারি নাই বলিয়াই এরূপ বলিয়াছি।”

বড়ু বলিল, “ভাই। আমার দুঃখ কি আপনি দূর করিবেন? আমি কবরে না গেলে এ দুঃখের শেষ হইবে না।”

আমি তাহার হাত দুইটি ধরিয়া বলিলাম, ‘বস্তু। আমি তো তোমার বড় ভাই। ছোট বোন হইয়া বড় ভায়ের অপরাধ কি মাফ করা যায় না?”

বস্তু বলিল, “ভাই। মাফ করিতে পারি, যদি আপনি কিরা করেন এসব কথা আর আমাকে বলিবেন না। আমার নলাটে যা লেখা ছিল তাহাই আমার হইয়াছে। তাহা আপনি কেমন করিয়া খণ্ডাইবেন?”

আমি বলিলাম, “বস্তু! তোমাকে আমি মনে মনে যে কতটা জানি তা আমার অন্তরই শুধু জানে। আমার দুনিয়ার সমস্ত জায়গা জুড়িয়া আছ তুমি। তোমার ইচ্ছার উপরে কি আমি কোনো কথা বলিতে পারি? আজ তোমার দু’খানা হাত কপালে ধরিয়া প্রতিজ্ঞা করিলাম এরূপ কথা আর তোমাকে কোনোদিন বলিব না। তুমি এই টাকা বালিশের তলায় যেখানে রাখিয়াছিলে সেইখানে রাখিয়া দাও।”

চলবে…..

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024