০৯:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
ঢাকার খিলক্ষেতের দুর্গা মন্দির ভাঙার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৬) চিতা-বাঘের শেষ আলোঝলক ঢাকা শহরের বাস সেবা: আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে? মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ও গঙ্গা জলচুক্তি নবায়ন নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের বড় একটি ভুল, প্রতিশোধ বনাম সংস্কার সাকিব আল হাসান: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অমর কিংবদন্তি বাংলা নাটকের সুপারস্টার অপূর্বের জন্মদিন আজ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৭৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
  • 27

বড়ু

বড়ু তাহাই করিল। তারপর আমাকে যেন খুশি করিবার জন্য একথা সে-কথা কত কথাই বলিল, “ভাই! তোমার শরীরটা যেন খারাপ হইয়া পড়িয়াছে। ভালোমতো খাওয়াদাওয়া কর। আচ্ছা ভাই। তুমি এত বড় ডাঙর হইলে বিবাহ করিলে না? তোমার বিয়ের দিন আমি যাইয়া দলবল লইয়া গান গাহিয়া আসিব।”

বাড়ি ফিরিতে কত কথাই মনে পড়িল; এই গরিব অশিক্ষিতা মেয়েটি এত বড় চরিত্রের বল কোথা হইতে পাইল। বর্তমান শিক্ষার আলোক পাইয়া আমরা একনিষ্ঠ প্রেমে বিশ্বাস হারাইয়াছি। কিন্তু এই মেয়েটি এক গা সৌন্দর্য লইয়া কোন শক্তির বলে এই অলস অপদার্থ স্বামীর গৃহে অনাহারে অবহেলায় দিনের পর দিন কাটাইতেছে! সে যদি মাত্র এতটুকু ইঙ্গিতও করিত, আমি তাহাকে অনায়াসে এই দারিদ্র জীবন হইতে টানিয়া আনিয়া রানীর হালে রাখিতে পারিতাম। পদ্মা নদীতে চর পড়ায় আমার পিতা তখন অনেক জমিজমার অধিকারী। আশেপাশের চার-পাঁচ গ্রামের মধ্যে আমার পিতার অবস্থা সবচাইতে ভালো। আমিও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্তর টাকা করিয়া জলপানি পাই। মেয়েটি ইহার সবকিছুই জানিত। আমার নীরব ভালোবাসার ইঙ্গিত তো সে কতভাবেই পাইত। তবু একদিনের জন্যও তাহাকে আপন আদর্শ হইতে কিঞ্চিৎ বিচ্যুত করিতে পারিলাম না। এই শক্তি সে কোথা হইতে পাইল, বারবার এই কথা আমার মনে হইতে লাগিল। আজও এই প্রশ্ন আমার মন হইতে যায় নাই। কিন্তু কোনো সদুত্তরই খুঁজিয়া পাইলাম না।

এই দেশের মাটিতে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী জন্মলাভ করিয়াছিল। সাত-দিনের শিশু-স্বামীকে কোলে করিয়া রূপবান কন্যা বনে-বনান্তরে ঘুরিয়া নানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। সুদূর বানিয়াচঙ্গ অঞ্চলে আজও সোনাই বিবির কবরে পুরললনারা সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাইয়া স্বামীর মঙ্গল-কামনা করে। শিশুবয়স হইতে এই মেয়েটি সেইসব কাহিনীর অধিকারিণী। তাই আজ তার কুঁড়ে-ঘরের আঙিনায় এই মেয়েটি যে সতীর পাঠ রচনা করিয়াছে, সেখানে রাক্ষস-খোক্কস আসিয়া হানা দেয় না-বনের বাঘ আসিয়া খাইতে

চাহে না কিন্তু নিত্য নতুন নতুন অভাব আসিয়া তাহাকে হানা দেয়। দারুণ রোগ-ব্যাধি আসিয়া তাহাকে গ্রাস করিতে চায়, নানা প্রলোভন আসিয়া তাহাকে জয় করিতে চায়। তবু সেই সতী-লক্ষ্মীর আসনটি সে চিরঅম্লান করিয়া রাখিয়াছে।

ইহার পর আরও কতবার বস্তুর সঙ্গে দেখা করিয়াছি। কলিকাতা হইতে শাড়ি কিনিয়া আনিয়া গোপনে তাহাকে দিয়া আসিয়াছি। ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে সমস্ত গ্রামের লোক খাইত। বড়ুদের জন্য ভালো ভালো খাবার তুলিয়া রাখিতাম। রাত হইলে ডালায় করিয়া সেই খাবারগুলি মাথায় করিয়া বস্তুদের বাড়ি যাইতাম।

“দাদি। ঘুমাইয়া আছ নাকি। সারাদিন লোকজনের খাওয়া-দাওয়ার গণ্ডগোলে আসিতে পারি নাই। তোমার জন্য সামান্য খাবার আনিয়াছি।”

চলবে…..

ঢাকার খিলক্ষেতের দুর্গা মন্দির ভাঙার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৭৬)

১১:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বড়ু

বড়ু তাহাই করিল। তারপর আমাকে যেন খুশি করিবার জন্য একথা সে-কথা কত কথাই বলিল, “ভাই! তোমার শরীরটা যেন খারাপ হইয়া পড়িয়াছে। ভালোমতো খাওয়াদাওয়া কর। আচ্ছা ভাই। তুমি এত বড় ডাঙর হইলে বিবাহ করিলে না? তোমার বিয়ের দিন আমি যাইয়া দলবল লইয়া গান গাহিয়া আসিব।”

বাড়ি ফিরিতে কত কথাই মনে পড়িল; এই গরিব অশিক্ষিতা মেয়েটি এত বড় চরিত্রের বল কোথা হইতে পাইল। বর্তমান শিক্ষার আলোক পাইয়া আমরা একনিষ্ঠ প্রেমে বিশ্বাস হারাইয়াছি। কিন্তু এই মেয়েটি এক গা সৌন্দর্য লইয়া কোন শক্তির বলে এই অলস অপদার্থ স্বামীর গৃহে অনাহারে অবহেলায় দিনের পর দিন কাটাইতেছে! সে যদি মাত্র এতটুকু ইঙ্গিতও করিত, আমি তাহাকে অনায়াসে এই দারিদ্র জীবন হইতে টানিয়া আনিয়া রানীর হালে রাখিতে পারিতাম। পদ্মা নদীতে চর পড়ায় আমার পিতা তখন অনেক জমিজমার অধিকারী। আশেপাশের চার-পাঁচ গ্রামের মধ্যে আমার পিতার অবস্থা সবচাইতে ভালো। আমিও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্তর টাকা করিয়া জলপানি পাই। মেয়েটি ইহার সবকিছুই জানিত। আমার নীরব ভালোবাসার ইঙ্গিত তো সে কতভাবেই পাইত। তবু একদিনের জন্যও তাহাকে আপন আদর্শ হইতে কিঞ্চিৎ বিচ্যুত করিতে পারিলাম না। এই শক্তি সে কোথা হইতে পাইল, বারবার এই কথা আমার মনে হইতে লাগিল। আজও এই প্রশ্ন আমার মন হইতে যায় নাই। কিন্তু কোনো সদুত্তরই খুঁজিয়া পাইলাম না।

এই দেশের মাটিতে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী জন্মলাভ করিয়াছিল। সাত-দিনের শিশু-স্বামীকে কোলে করিয়া রূপবান কন্যা বনে-বনান্তরে ঘুরিয়া নানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। সুদূর বানিয়াচঙ্গ অঞ্চলে আজও সোনাই বিবির কবরে পুরললনারা সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাইয়া স্বামীর মঙ্গল-কামনা করে। শিশুবয়স হইতে এই মেয়েটি সেইসব কাহিনীর অধিকারিণী। তাই আজ তার কুঁড়ে-ঘরের আঙিনায় এই মেয়েটি যে সতীর পাঠ রচনা করিয়াছে, সেখানে রাক্ষস-খোক্কস আসিয়া হানা দেয় না-বনের বাঘ আসিয়া খাইতে

চাহে না কিন্তু নিত্য নতুন নতুন অভাব আসিয়া তাহাকে হানা দেয়। দারুণ রোগ-ব্যাধি আসিয়া তাহাকে গ্রাস করিতে চায়, নানা প্রলোভন আসিয়া তাহাকে জয় করিতে চায়। তবু সেই সতী-লক্ষ্মীর আসনটি সে চিরঅম্লান করিয়া রাখিয়াছে।

ইহার পর আরও কতবার বস্তুর সঙ্গে দেখা করিয়াছি। কলিকাতা হইতে শাড়ি কিনিয়া আনিয়া গোপনে তাহাকে দিয়া আসিয়াছি। ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে সমস্ত গ্রামের লোক খাইত। বড়ুদের জন্য ভালো ভালো খাবার তুলিয়া রাখিতাম। রাত হইলে ডালায় করিয়া সেই খাবারগুলি মাথায় করিয়া বস্তুদের বাড়ি যাইতাম।

“দাদি। ঘুমাইয়া আছ নাকি। সারাদিন লোকজনের খাওয়া-দাওয়ার গণ্ডগোলে আসিতে পারি নাই। তোমার জন্য সামান্য খাবার আনিয়াছি।”

চলবে…..