সারাক্ষণ রিপোর্ট
বিশ্বজুড়ে ওষুধশিল্প বর্তমানে একটি বড় ধরনের সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশ থেকে আমদানি করা ওষুধের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের কথা ভাবছে। ভারতের মতো দেশ, যারা তুলনামূলকভাবে কম দামে জেনেরিক ওষুধ সরবরাহ করে, এই সম্ভাব্য শুল্কের কারণে বিশেষ চাপে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ আমদানি পরিসংখ্যান
মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২৪৬.৮ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ ও চিকিৎসা-সম্পর্কিত পণ্য আমদানি করে, যা তাদের মোট পণ্য আমদানির ৭.৬%। ২০২৩ সালে আমদানি হওয়া ওষুধের মধ্যে প্রায় ২০% আসে আয়ারল্যান্ড থেকে, ১০.৭% জার্মানি থেকে, ৮.৫% সুইজারল্যান্ড থেকে এবং ৬.২% ভারত থেকে। জাপান থেকে আসে ৩.৭%।
জেনেরিক ওষুধের ওপর সম্ভাব্য শুল্কের প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত ৯০% ওষুধই জেনেরিক, যার বড় অংশ ভারত ও ইসরায়েল থেকে আসে। এই ক্ষেত্রে ভারতের লুপিন এবং ইসরায়েলের টেভা ফার্মাসিউটিক্যালস শীর্ষস্থানীয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র জেনেরিক ওষুধের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তাহলে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে এবং উৎপাদনকারী দেশগুলো ব্যবসায়িক চাপে পড়বে। ভারতের সরকার সম্ভাব্য শুল্ক সমস্যা মোকাবিলায় একটি বাণিজ্য চুক্তির কথা ভাবছে, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে আলোচনায় ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপনের জটিলতা
ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ওষুধ-উৎপাদন বাড়াতে চায়। কিন্তু এ জন্য নতুন প্ল্যান্ট তৈরি করতে অনুমোদনসহ নানা প্রক্রিয়ায় সাধারণত ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায় এবং প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতকারকরা অপেক্ষাকৃত কম মুনাফার মার্জিনে কাজ করে; তাই এত বড় বিনিয়োগ তাদের জন্য অত্যন্ত চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
জেনেরিক ওষুধের দামের সম্ভাব্য বৃদ্ধি
উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলসহ বিভিন্ন সাধারণ রোগের চিকিৎসায় জেনেরিক ওষুধ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন শুল্ক আরোপ করলে ওই ওষুধগুলোর দাম বেড়ে যাবে, ফলে কোম্পানিগুলোর লাভ কমতে পারে এবং উৎপাদনে কাটছাঁট করলে গুণগত মানও ঝুঁকিতে পড়তে পারে। উদাহরণ হিসেবে, যদি ২৫% শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে একটি হৃদরোগের ওষুধের মূল্য এক পিলের জন্য ৮২ সেন্ট থেকে বেড়ে ৯৪ সেন্ট হতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসার মতো দীর্ঘমেয়াদি থেরাপিতে কয়েক হাজার ডলার অতিরিক্ত খরচ লাগতে পারে।
বৃহত্তর ওষুধপ্রস্তুতকারকদের প্রতিক্রিয়া
বায়ার, নোভার্টিসসহ বড় বড় ওষুধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয় ফেডারেশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস-এর (এফপিআইএ) সদস্য। তারা ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ব্যবসা সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বাড়ায়, তাহলে ইউরোপের ওষুধশিল্পের একটি বড় অংশ সেখানেই স্থানান্তরিত হতে পারে।
আয়ারল্যান্ডে ওষুধশিল্পের গুরুত্ব
আয়ারল্যান্ড দক্ষ জনবল ও তুলনামূলকভাবে কম করহারের কারণে বড় বড় ফার্মা কোম্পানির জন্য আকর্ষণীয় কেন্দ্র। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি মার্কিন ফাইজার, এলি লিলি ও জাপানের টাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং অ্যাস্টেলাস ফার্মারও সেখানে উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রবণতা
শুল্ক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে কিছু ইউরোপীয় কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। নোভার্টিস আগামী পাঁচ বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সিইও বাস নারাসিমহান বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে এই বিনিয়োগ সরবরাহ শৃঙ্খল ও প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মকে শক্তিশালী করবে। এ ছাড়া এলি লিলি নতুন চারটি প্ল্যান্ট তৈরিতে ২৭ বিলিয়ন ডলার এবং জনসন অ্যান্ড জনসন চার বছরে ৫৫ বিলিয়ন ডলার খরচের পরিকল্পনা করেছে।
চীনা উপাদানের ওপর নির্ভরতা
মার্কিন হাসপাতাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩০% সক্রিয় ওষুধ উপাদান চীন থেকে সংগ্রহ করে। এ ধরনের উপাদানে যদি শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে মার্কিন মুলুকে কারখানা থাকলেও উত্পাদনকারী কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়বে।
জাপানি কোম্পানির অবস্থান
যদি শুল্ক কার্যকর হয়, জাপানের ওষুধশিল্পও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ২০২৪ সালে জাপান যুক্তরাষ্ট্রে ৪১১.৪ বিলিয়ন ইয়েনের ওষুধ রপ্তানি করেছে। টাকেদা তাদের মোট রাজস্বের অর্ধেকের বেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়, অ্যাস্টেলাস পায় ৪১%, আর দাইইচি সাঙ্কিও ও এসাই- এর আয় ৩১% আসে মার্কিন বাজার থেকে।
উৎপাদন কেন্দ্র সম্প্রসারণের পদক্ষেপ
দাইইচি সাঙ্কিও তাদের ক্যান্সার ওষুধ ‘এনহের্টু’ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানিতে উৎপাদন করে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে অতিরিক্ত গবেষণা ও উৎপাদন কেন্দ্র তৈরিতে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে, যা ২০২৭ অর্থবছরের মধ্যে চালু হবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়লে শুল্কের প্রভাব কিছুটা কমতে পারে, যদিও এটির মূল লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ।
সারাংশ
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানি কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পুরোপুরি নতুন প্ল্যান্ট তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তবে তারা সেখানে আগে থেকেই থাকা সুবিধাগুলোতে উৎপাদন বাড়াতে পারে বা কোনো চুক্তিভিত্তিক প্রস্তুতকারকের সাহায্য নিতে পারে। সামগ্রিকভাবে এই সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের প্রভাব স্বল্পমেয়াদে এবং দীর্ঘমেয়াদে—দুটো দিকেই বৈশ্বিক ওষুধশিল্পকে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করতে পারে।
Leave a Reply