সারাক্ষণ রিপোর্ট
রেকর্ড দামে সোনার ঊর্ধ্বগতি
২০২৫ সালের এপ্রিলে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্য শুল্কের ঘোষণার পরই সোনার দাম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ১১ এপ্রিল, প্রতি ট্রয় আউন্স সোনার মূল্য ৩,২০০ ডলারেরও বেশি ছুঁয়ে যায়। তবে এই দাম বৃদ্ধিও সোনার প্রতি ভোক্তাদের আকর্ষণ কমাতে পারেনি। মুম্বাইয়ের জুয়েলারি দোকানগুলোতে চলছে পুরনো গয়না বদলে নতুন নেয়ার অফার, যা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ভারত ও চীনে অগ্রগামী চাহিদা
২০২৪ সালে ভারতীয়রা বিয়েসহ প্রয়োজনীয় উপলক্ষে সোনার গয়না কিনেছে ব্যাপক হারে। পুরনো গয়না বদল ও সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
- গয়না কেনা: ভারত – ৫৬০ টন, চীন – ৫১০ টন
- সোনার বার ও মুদ্রা: চীন – ৩৪৫ টন, ভারত – ২৪০ টন
থাইল্যান্ডেও অনলাইন মাধ্যমে সোনা কেনা বেড়ে চাহিদা ১৭% বেড়ে ৪০ টনে দাঁড়িয়েছে।
সামগ্রিকভাবে এশিয়া ব্যক্তিগত সোনার চাহিদার ৬৪.৫% দখল করেছে।

সংস্কৃতি নাকি সঞ্চয়ের মাধ্যম?
ভারতের বিয়ে, দীপাবলি বা অক্ষয় তৃতীয়ায় সোনা কেনা একটি প্রথা। দেশে বছরে প্রায় ১ কোটি বিয়ে হয়, যেখানে প্রায় ৩০০-৪০০ টন সোনা ব্যবহৃত হয়। চীনেও শিশুর জন্ম বা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য সোনা কেনা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী চীনা সমাজে বিয়েতে চার ধরনের গয়না উপহার দেওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা: সীমাবদ্ধ বাজারে সোনা বিনিয়োগের বিকল্প
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শেয়ারবাজারে সীমাবদ্ধ সুযোগ, বিদেশি বিনিয়োগে বাধা এবং মূলধন প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ থাকায় সোনা হয়েছে অন্যতম বিকল্প।
ভারতের গড় পরিবারের ১৫% সম্পদ সোনায়, যেখানে শেয়ারবাজারে মাত্র ৬%।
চীনে আবাসন খাতে ধসের পর সোনায় বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০২০-২৫ সময়ে সোনার দাম দ্বিগুণ হয়ে বার্ষিক ১৫.৪% হারে রিটার্ন দিয়েছে।
পেনশনহীন সমাজে সুরক্ষার প্রতীক
চীন, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক কর্মজীবীর জন্য সোনা হচ্ছে একমাত্র নিরাপদ সঞ্চয়ের মাধ্যম। নারীদের ক্ষেত্রে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের আয় তুলনামূলক কম এবং সম্পত্তিতে মালিকানা কম দেখা যায়।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে সোনার ব্যবহার
ভারতের কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনিশ্চিত আয়ের কারণে ছোট অঙ্কে সোনা কিনে রাখে। দুর্দিনে এসব সোনা বন্ধক দিয়ে সহজে ঋণ পাওয়া যায়। মুথুট ফাইন্যান্সের মতো প্রতিষ্ঠান ১৫ মিনিটে ঋণ দিচ্ছে, যার ফলে ২০২৪ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বরে সোনা বন্ধক ঋণ ৬৮% বেড়েছে।
অর্থনীতিতে সোনার নেতিবাচক প্রভাব
অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয় যদি সোনার বদলে উৎপাদনশীল খাতে যেত, তাহলে অর্থনীতি আরও লাভবান হতো।
থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, সোনা আমদানির জন্য দেশটি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে চলে গেছে।
ভারত ২০২৪ অর্থবছরে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সোনা আমদানি করেছে, যা রুপির ওপর চাপ বাড়িয়েছে।

সমাধান সহজ নয়
সরকার চাইলে সোনার কেনায় নিরুৎসাহিত করতে পারে, তবে এতে চোরাচালান বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। দেশীয় উৎপাদনও কম—চীন ২০২৩ সালে ৩৭৮ টন উৎপাদন করলেও চাহিদার ৪০% পূরণ হয়েছে মাত্র। ভারত ২০২২ সালে মাত্র ১ টন সোনা উৎপাদন করেছে, অথচ আমদানি করেছে ৭০০ টনের বেশি।
সোনার চাহিদা কমাতে হলে সরকারকে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার উদ্যোগ—
- ঋণ বাজার উন্নয়ন
- জমির রেকর্ড ঠিক করা
- বিচারব্যবস্থা সংস্কার
- মূলধনের স্বাধীন চলাচল নিশ্চিত করা
উপসংহার: সংস্কৃতির চেয়েও বড় বিষয় অর্থনীতি
যদিও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সোনার চাহিদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, আসলে অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধ বিনিয়োগ কাঠামোই এশিয়ার সোনার প্রতি আগ্রহের মূল চালক।
Sarakhon Report 


















