আদনান আমির
ইসলামাবাদ—ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত যখন দ্বিপাক্ষিক পানিবণ্টন চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনে, তার ঠিক এক দিন পর বৃহস্পতিবার পাকিস্তান একই রকম পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। ইসলামাবাদ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ইন্দাস নদীর পানিপ্রবাহে কোনো পরিবর্তন ঘটানো হলে সেটিকে ‘যুদ্ধেরই নামান্তর’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং দেশের পূর্ণ শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া হবে।
বুধবার ভারত জানায়, তারা ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটিকে স্থগিত রাখছে, পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করছে, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য আঞ্চলিক ভিসা অব্যাহতি বাতিল করছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নিম্নমুখী করছে।
সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালি নাগরিক নিহত হওয়ার এক দিন পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে একটি অল্প পরিচিত গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করে। পাশাপাশি, ভারত নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখে।
এর প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক হয়। শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তান-ভারত ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ করা হবে, দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের ট্রানজিট ও বাণিজ্য স্থগিত থাকবে, ভারতীয় নাগরিকদের জন্য আঞ্চলিক ভিসা অব্যাহতি বাতিল করা হবে এবং ভারতীয় প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করতে হবে।
কমিটি আরও সিদ্ধান্ত নেয়, ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মীর সংখ্যা ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে, পাকিস্তানের আকাশসীমা ভারতীয় মালিকানাধীন বা পরিচালিত সব উড়োজাহাজের জন্য বন্ধ থাকবে এবং সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত রাখা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়, “ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটি অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রাপ্য পানিপ্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে মোড় নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা ও নিম্ন অববাহিকার অধিকার হরণকে যুদ্ধের নামান্তর হিসাবে দেখা হবে এবং জাতীয় শক্তির সব স্তর দিয়ে পূর্ণ শক্তিতে জবাব দেওয়া হবে।”
জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের আগে উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক ডার এক স্থানীয় টিভি চ্যানেলকে বলেন, “পাহালগাম হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ ভারত দেয়নি।”
ইসলামাবাদভিত্তিক পলিসি রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক আহসান হামিদ দুররানি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, “কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস, পাকিস্তানি কর্মীদের বহিষ্কার ও সীমান্ত ক্রসিং বন্ধের পদক্ষেপ সংলাপের পথ আরও সংকুচিত করে। এসব ব্যবস্থা পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।”
পাকিস্তানের মূল উদ্বেগ ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটি স্থগিত হওয়া। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী ইন্দাস, ঝেলাম ও চেনাব—এই তিন নদী থেকে মোট প্রায় ৮০ শতাংশ পানি পাকিস্তান পায়।
পাকিস্তান ইন্দাস নদী ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দাস বিষয়ক গবেষক ও প্রভাষক এরুম সাত্তার নিক্কেইকে জানান, “পাকিস্তান বলতে গেলে শুধু ইন্দাস নদী ব্যবস্থার ওপরই নির্ভরশীল । চুক্তির আওতাভুক্ত নদীগুলো থেকে চারটি প্রদেশই প্রধানত পানি পায়। আফগানিস্তান থেকে আসা দু-একটি নদী ছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্য কোনো উৎস নেই।”
তবে সাত্তার মনে করেন, ভারত একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত করা সহজ হবে না। তাঁর ভাষায়, “চুক্তিটি একতরফাভাবে স্থগিত করা যায় না। এটি আন্তর্জাতিক আইনের একটি দলিল; দীর্ঘ আলোচনা করে স্বাক্ষরিত চুক্তি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ—এমন শক্ত যুক্তি পাকিস্তান দিতে পারে।”
সম্প্রতি ভারত চুক্তির শর্ত পরিবর্তনের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে এবং গত বছর ইসলামাবাদকে অবহিত করেছে যে, তারা চুক্তি পর্যালোচনা করতে চায়; পাকিস্তান সেটি গ্রহণ করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের পদক্ষেপ মূলত পাকিস্তানের টালমাটাল অর্থনীতি ও কৃষিকে আঘাত করতেই নেওয়া হয়েছে।
ইসলামাবাদের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের অধ্যাপক তাহির নঈম মালিক নিক্কেইকে বলেন, “পাকিস্তানে ইতিমধ্যে পানি সংকট রয়েছে; এ ধরনের পদক্ষেপ ওই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে।”
তবে সাত্তার সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ভারত আসলে নদীর প্রবাহ থামাতে পারবে কিনা। তিনি বলেন, “বাস্তবে ডাউনস্ট্রিমে পানি আটকে রাখতে বিপুল অবকাঠামো দরকার, যা তত্ত্বগতভাবেও অত্যন্ত কঠিন, বিপুল অর্থ ব্যয়সাপেক্ষ এবং নির্মাণে কয়েক দশক লেগে যাবে।”
পানিচুক্তি ছাড়াও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, ২০১৯ সালের মতো উত্তেজনা আবার বাড়তে পারে। ওই বছর ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলায় ৪০ জন ভারতীয় নিরাপত্তা সদস্য নিহত হন। প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় এবং পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেয়।
সরকারের এক কর্মকর্তা নিক্কেইকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা আশঙ্কা করছি, ভারত পাহালগাম হামলাকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে তথাকথিত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালাতে পারে,” বিষয়টি দেখভাল-করছেন—এমন এক সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিক্কেইকে বলেন।
“আমরা সংঘাত চাই না, তবে ভারতের কোনো দুঃসাহসী অভিযানের মুখোমুখি হলে জবাব দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি,” তিনি যোগ করেন।
অধ্যাপক তাহির নঈম মালিকের মতে, এ যাত্রায় সরাসরি বিমান হামলার আশঙ্কা তুলনামূলক কম, কারণ আন্তর্জাতিক অংশীজন—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র—ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সক্রিয় থাকবে। তবু তিনি সতর্ক করেন, “যেকোনো ভুল পদক্ষেপ দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলতে পারে, এবং উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।”
— আদনান আমির, পাকিস্তানি সাংবাদিক
Leave a Reply