পায়েল সামন্ত, কলকাতা
আরো একটি অগ্নিকাণ্ডে ভারতের কলকাতায় প্রাণ গেল ১৫ জনের। বারবার এ ধরনের ঘটনার সাক্ষী থাকছে মহানগর। আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার দাবি করলেও কেন ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড?
নন্দরাম মার্কেট থেকে স্টিফেন কোর্ট হয়ে মেছুয়া বাজারের হোটেল ঋতুরাজ। গত দু দশকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়েছে কলকাতায়। যতবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে, ততবারই অগ্নিসুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু পরিস্থিতি থেকে যায় সেই তিমিরেই।
কলকাতার অগ্নিকাণ্ড
শহর কলকাতায় বহু জায়গা ঘন বসতিপূর্ণ ও ঘিঞ্জি। তেমনই একটি জায়গায় রয়েছে হোটেল ঋতুরাজ। বড়বাজারের এই এলাকা শহরের অন্যতম প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। যদিও ইতিহাসের পাতায় নজর রাখলে দেখা যাবে, অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গাতেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়েছে কলকাতায়।
২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি ব্রেবোর্ন রোডের নন্দরাম মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রায় চার হাজার দোকানের কর্ণধাররা তাদের সর্বস্ব হারায়। আগুন এত ভয়াবহ ছিল যে চারদিন লেগেছিল তা নেভাতে। এই মার্কেটে ২০১৯ সালে আরো একবার আগুন লেগেছিল।
আগুনের ব্যাপকতা ও মর্মান্তিক পরিণতির বিচারে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতাল সঙ্গে তুলনীয় কোনো ঘটনা শহরে ঘটেনি। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ স্টিফেন কোর্টে মারা যান ৪২ জন। কেউ আগুনে পুড়ে, কেউ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। কেউ বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়ে মারা যান।
দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল অসহায় রোগীদের। আগুনে পুড়ে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান ৯২ জন। কারো মৃত্যু না হলেও ২০১৮ এর ১৬ সেপ্টেম্বর বাগড়ি মার্কেটের আগুন ছিল ভয়াবহ। এই বাজারের ছটি তল ছাই হয়ে যায়। এখানেও আগুন নেভাতে দিন চারেক সময় লেগেছিল।
মেছুয়া ফলপট্টির আগে সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল ২০২১-এর ৮ মার্চ। ভাগীরথী হুগলি নদীর ধারে স্ট্রান্ড রোডে নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিং-এ ১৪ তলায় আগুন লাগে। এতে মারা যান ৯ জন। বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও অগ্নিসুরক্ষা নিয়ে যে ঢিলেমি রয়েছে, তা প্রমাণ করে দিয়েছে মেছুয়াপট্টি।
দমকল ঘিরে প্রশ্ন
মঙ্গলবার রাত আটটা নাগাদ মেছুয়া ফলপট্টির হোটেলে আগুন লাগে। আগুন নিমেষে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ জানিয়েছেন দমকলের ভূমিকা নিয়ে ।
জোড়াসাঁকো থানার মদনমোহন বর্মন স্ট্রিটের উপরে এই হোটেল। এখান থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ও লালবাজারের দমকল কেন্দ্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে। স্থানীয়দের অভিযোগ, খবর দেয়ার ২০- ২৫ মিনিট পরে দমকল আসে ।
এখানকার অপরিসর রাস্তা, সারিবদ্ধ দোকান দমকলের গাড়ি প্রবেশের ক্ষেত্রে সব সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এই ধরনের জায়গায় আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো দমকল বিভাগের আছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তারা অতীতে দাবি করেছেন।
তাদের বক্তব্য ছিল, ফায়ার বল থেকে শুরু করে ছোট আকারের গাড়ি তাদের কাছে রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, মেছুয়াতে দমকলের বড় গাড়ি এসেছিল, ছোট মাপের গাড়ি বা ফায়ার বলের ব্যবহার চোখে পড়েনি।
ডিডাব্লিউ চিত্র সাংবাদিক সত্যজিৎ সাউ ঘটনাস্থলে গিয়ে জানিয়েছেন, বাড়িটার বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে এত বড় একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। কোনো পোড়া বা কালো দাগ বাড়ির বাইরে নেই। অথচ বাড়ির ভিতরে আগুনে প্রচণ্ড তাপ ও ধোঁয়া তৈরি হয়েছিল। মূলত চারতলার বাসিন্দারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা বিপদের সময় সিঁড়িও ব্যবহার করতে পারেননি। দমবন্ধ হয়ে বা শ্বাসকষ্টেই মূলত মৃত্যু হয়েছে। দমকল বাহিনী জানলার কাচ ভেঙে উদ্ধার করেছেন।
ঘটনাস্থলে মুখ্যমন্ত্রী
দিঘা থেকে ফিরে বৃহস্পতিবার বড়বাজারের দুর্ঘটনাস্থলে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা ও দমকল মন্ত্রীর কাছে বিস্তারিত তথ্য নেন তিনি। দমকল কর্মীদের কাজের প্রশংসা করেন। বলেন, “জীবন আগে। যে বাড়িগুলি বিপজ্জনক, তাদের মালিকদের সঙ্গে কথা বলা হবে। প্রয়োজনে তাদের সরিয়ে অবিলম্বে মেরামতির কাজ করা হবে।”
তার বক্তব্য, কলকাতায় বহু বাড়ি রয়েছে, যেগুলোকে বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে পুরসভা। কিন্তু মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতায় বাড়ির মেরামত হয়নি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই সেখানে বাস করছেন অনেকে। অবিলম্বে দমকল মন্ত্রী ও কমিশনারকে বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন তিনি। দ্রুত বাড়ি ফাঁকা করে মেরামতির কাজ শুরু করতে বলেন। একই সঙ্গে পুরোনো হোটেলগুলিতে মাঝেমধ্যেই পুলিশকে সারপ্রাইজ ভিজিটের নির্দেশও দেন।
ঢিলেঢালা অগ্নিসুরক্ষা
যে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান, বিপণি চালাতে গেলে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফায়ার লাইসেন্স নিতে হয়। এই লাইসেন্স নির্ধারিত সময় অন্তর পুনর্নবীকরণ করাতে হয়। প্রাথমিক তদন্তের পরে দমকল দাবি করেছে, এই হোটেলের ফায়ার লাইসেন্সের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে তিন বছর আগে। এরপর আর লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করাননি হোটেলের কর্ণধার।
এই তথ্য সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠেছে, বছরের পর বছর ফায়ার লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে ব্যবসা করছে কোনো প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে এই হোটেলে থাকতে আসা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করা না হলে তা চিহ্নিত করার জন্য পর্যাপ্ত নজরদারি ও আইন ভাঙার ক্ষেত্রে জরিমানা কেন করা হচ্ছে না?
শুধু ফায়ার লাইসেন্স নয়, ট্রেড লাইসেন্স-এর ক্ষেত্রেও বড়সড় গলদ সামনে এসেছে। প্রাথমিক তদন্তে পুরসভার কর্তারা দেখেছেন, মদনমোহন বর্মন স্ট্রিটের হোটেল ঋতুরাজ বলে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। এই জায়গাটি রয়েছে বলরাম প্রপার্টিজ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে। প্রশ্ন উঠছে, ফায়ার লাইসেন্স দূরের কথা, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে একটি হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে!
বাণিজ্যিক ফায়ার লাইসেন্স ১১ মাস অন্তর পুনর্নবীকরণ করানোর কথা। ফায়ার অডিট করার কথাও বলা আছে। এসব ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য দমকলের সারপ্রাইজ ভিজিট করার কথা। সেটা প্রায় হয় না বললেই চলে। দমকলের ডিজি রণবীর কুমারের বক্তব্য, “এবার থেকে সারপ্রাইজ ভিজিট করতে হবে। যাদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়নি, তাদের ক্ষেত্রেও নজরদারি দরকার। একইসঙ্গে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডিডব্লিউকে বলেন, “শহরে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের একটা মূল জায়গা হচ্ছে শর্ট সার্কিট। বাড়ির পরিচর্যার মতো বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। যে সমস্ত জায়গায় অনেক মানুষের সমাগম হয়, সেখানে অগ্নিসুরক্ষা খুব দরকারি। ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টর এগুলো নূন্যতম জিনিস। আগুন লাগলে যদি সাইরেন বাজত, তাহলে মেছুয়াপট্টির হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে মানুষগুলোর পাঁচ মিনিট লাগত। এখানে অ্যালার্ম নেই, ফলে ন্যূনতম সতর্কতা নেই।”
তিনি ব্যখ্যা করেন, “কলকাতা পুরোনো ও ঘিঞ্জি শহর, যেখানে জনঘনত্ব ও বাড়ির ঘনত্ব বেশি। তাই এই পুরোনো অবিন্যস্ত শহরকে অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে তদারকি করা উচিত। যাদের হাতে শহরের সুরক্ষা, তাদের কিছুদিন অন্তর অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা উচিত। অগ্নিসুরক্ষা সার্টিফিকেট নিয়ে হোটেল, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ চলছে কিনা, নজরদারি করা দরকার। যদি সেখানে ত্রুটি থাকে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অগ্নিসুরক্ষার জন্য উপযুক্ত আইন আমাদের আছে, সেটা বলবৎ হচ্ছে কিনা সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে সরকার বা পুরসভাকে। তারা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটবে।”
তদন্তে কমিটি গঠন
মেছুয়ার অগ্নিকাণ্ড নিয়ে তদন্তে একটি দল গঠন করা হয়েছে। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন পুর কমিশনার ধবল জৈন। ছয় সদস্যের কমিটিতে একাধিক পুর আধিকারিক রয়েছেন। এই কমিটির সঙ্গে বুধবার বৈঠক করেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। দ্রুত এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট দেয়ার কথা বলেছেন তিনি।
এ ধরনের কমিটি গঠন কোনো বড় বিপর্যয়ের পর হয়েই থাকে। বছর তিনেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে দিয়েছিলেন। ২০২২ সালে ট্যাংরার একটি চামড়ার গুদামে অগ্নিকাণ্ডের পর এই কমিটি তৈরি করা হয়। একটি কমিটির সদস্য ছিলেন কলকাতার মেয়র ও দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু। অন্য কমিটির মাথায় ছিলেন দমকলের এডিজি। এই কমিটির কাজ ছিল অগ্নিকাণ্ড প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা ও অগ্নি সুরক্ষার পদক্ষেপ সংক্রান্ত সুপারিশ জানানো।
সূত্রের খবর, এই কমিটির কয়েকটি বৈঠক হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা থেকে লাভ কতটা হয়েছিল? দমকল মন্ত্রীর দাবি, প্রয়োজন অনুযায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শহরের একাধিক ঝুপড়ি এলাকায় হাইড্রেন তৈরি করে দিয়েছে পুরসভা।
দমকলের সাবেক অধিকর্তা বিভাস গুহ বলেন, “অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় নজরদারি চালানোর জন্য যে আধিকারিক ও কর্মী দরকার, সেই সংখ্যাও অসম্ভব কমে গিয়েছে। পরিকাঠামোগত লোকবলের ঘাটতির জন্যই একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে। ঋতুরাজের ক্ষেত্রে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বেতনভুক কর্মী ছিলেন না। ফলে পরিকাঠামো খাতায়-কলমে যা ছিল, প্রয়োজনের সময় সেটা কাজে আসেনি।”
আমরি বা স্টিফেন কোর্টের সঙ্গে মেছুয়া বাজারের অগ্নিকাণ্ডের কী তফাৎ? বিভাস বলেন, “আমরিতে সেন্ট্রাল এসির ডাক্ট দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়েছিল। এর মধ্যে ড্যাম্পার থাকে। তাতে ঠান্ডা হাওয়া ছাড়া আগুন বা ধোঁয়া গেলেই অ্যান্টি লক সিস্টেম সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থাটা কাজ করেনি। তার উপরে নিরাপত্তাকর্মীরা ফায়ার এলার্ম বন্ধ করে রাখায় ডিটেক্টর, স্প্রিংকলার কাজ করেনি। ফলে ভয়াবহ পরিণতি এড়ানো যায়নি।”
অধ্যাপক বিশ্বাস বলেন, “আমরি হাসপাতালের ঘটনা থেকে যে আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি, সেটা মেছুয়াপট্টির অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করেছে। মানুষ নিরাপদ ভেবে যে জায়গায় যাচ্ছে, সেই নিরাপত্তা যদি প্রশ্নের মুখে পড়ে, তাহলে দু’পক্ষ দায়ী। একদিকে যেমন হোটেল মালিকেরা, বাজার কর্তৃপক্ষ বা হাসপাতাল দায়ী, একই সঙ্গে সরকারের দায়। সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি বলেই আমরি থেকে মেছুয়াপট্টি পর্যন্ত মৃত্যুমিছিল চলছে। আমরা জতুগৃহে বাস করছি। ”
ডিডাব্লিউ ডটকম