সারাক্ষণ রিপোর্ট
ভারতের জাতীয় গণনায় জাতি (কাস্ট)-ভিত্তিক গণনা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম চালু হওয়া এই ব্যবস্থা আবার ফিরে এসেছে নতুন অর্থ ও প্রেক্ষাপটে। এই তথাকথিত ‘জাতিগত জনগণনা’ একদিকে যেমন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়কে শাণিত করবে, অন্যদিকে এটি সমাজে সম্পদ ও রাজনৈতিক সুযোগের সুষম বণ্টনের জন্য তথ্যভিত্তিক নীতিমালাও তৈরিতে সহায়তা করবে।
জাতিগত দাবি থেকে প্রতিনিধিত্বের রাজনীতিতে উত্তরণ
এই জনগণনা সমাজে অনুন্নত ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর দাবি শুধু উন্নয়নের নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দিকেও সরিয়ে নেবে। এতে করে নানা জাতি ও উপ-জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি নতুনভাবে উন্মোচিত হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজকে আরও ন্যায়সঙ্গত ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে সাহায্য করবে।
বিজেপির কৌশলী পাল্টা চাল: বিরোধীদের ভরকেন্দ্র দুর্বল
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এই সিদ্ধান্ত বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের কৌশলে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশেষ করে বিহারের মতো রাজ্যে, যেখানে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের জন্য বিরোধীরা ওবিসি ও দলিত সম্প্রদায়কে জাতিগত জনগণনার মাধ্যমে সংগঠিত করার পরিকল্পনা করছিল, তাদের এখন নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে।
বিজেপির নতুন সামাজিক ন্যায় মডেল: ‘সমগ্র সামাজিক ন্যায়‘
বিজেপি শুধু বিরোধীদের জাতি-ভিত্তিক ভোটরাজনীতির অস্ত্র ভেঙে দিয়েছে তাই নয়, বরং সামাজিক ন্যায়ের তত্ত্বকে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। একে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ‘সমগ্র সামাজিক ন্যায়’ মডেল হিসেবে দেখছেন, যেখানে জাতিগত প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শাসন ও ক্ষমতায় অংশগ্রহণকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিজেপির পরিচয়ের রূপান্তর: সর্বসমাজের দল হয়ে ওঠা
ঐতিহাসিকভাবে ব্রাহ্মণ-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি এখন নিজেকে ‘সর্বসমাজের’ প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করছে। এই রূপান্তর বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের ওবিসি ও দলিতদের বড় অংশকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করেছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ও সমাজবাদী পার্টির (এসপি) মতো দলগুলোর প্রভাব কমে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিরোধী দলের সংকট: একমাত্রিক থেকে বহুমাত্রিক রাজনীতির প্রতিযোগিতা
আরজেডি ও এসপির মতো দলগুলোর একমাত্রিক ‘জাতিগত সামাজিক ন্যায়’ তত্ত্বকে এখন বিজেপির বহুস্তরবিশিষ্ট সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ন্যায়ের ধারণার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রথম বড় পরীক্ষা হবে বিহার নির্বাচনে, তবে এর প্রতিধ্বনি শোনা যাবে জাতীয় রাজনীতিতেও।
উচ্চবর্ণদের প্রতিক্রিয়া ও হিন্দুত্বের রক্ষা বলয়
যদিও কিছু হিন্দু উচ্চবর্ণ এই জাতিগত জনগণনার বিরোধিতা করতে পারে, তবুও বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ, পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং ‘উন্নত ভারত’-এর প্রতিশ্রুতি তাদের দলে রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে, সমাজে জাতি-ভিত্তিক বিভাজনকে তারা অতিক্রম করতে পারবে।
জাতীয় জনগণনা বনাম রাজ্যভিত্তিক জরিপ
বিভিন্ন রাজ্য সরকার যে জাতি-ভিত্তিক জরিপ করেছে তা এই জাতীয় জনগণনার তুলনায় গুরুত্ব হারাতে পারে। কারণ জাতীয় পর্যায়ের জনগণনা আরও পদ্ধতিগত, নিরপেক্ষ ও বিশদ তথ্য সরবরাহ করবে, যা নীতি প্রণয়নে সহায়ক হবে। রাজনৈতিক দলগুলো রাজ্যের তথ্য ব্যবহার করে জাতীয় তথ্যকে শক্তিশালী বা চ্যালেঞ্জ করতে পারে, কিন্তু ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্যই চূড়ান্ত প্রভাব ফেলবে।
একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা
জাতিগত জনগণনা অবশেষে ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এটি শুধু ক্ষমতার কাঠামো বদলাবে না, বরং সমাজের উচ্চবর্ণ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সম্পর্কেও নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।
Leave a Reply