মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ১১:০০ অপরাহ্ন

পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে কেন ছাত্রীরা?

  • Update Time : সোমবার, ৫ মে, ২০২৫, ৬.০০ পিএম
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে (প্রতীকী ছবি)

পায়েল সামন্ত,কলকাতা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে পিছিয়ে পড়েছে ছাত্রীরা৷ ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরাই বেশি পরীক্ষায় বসেছে৷ কিন্তু তাদের পাশের হার ছাত্রদের তুলনায় কম৷

শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল৷ এই ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রীদের ফলাফলের ছবিটা চিন্তাজনক৷

পাশের হারে এগিয়ে ছেলেরা

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বার মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৯ লক্ষ ৭০ হাজার৷ এর মধ্যে ৪ লক্ষ ২৫ হাজারের মতো ছিল ছাত্র, ৫ লক্ষ ৪৩ হাজার ছাত্রী৷ ছেলেদের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি ছাত্রী পরীক্ষায় বসেছিল৷

পাশের হারে ছাত্রীদের পিছনে ফেলে দিয়েছে ছাত্ররা৷ প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্র পাশ করেছে৷ ছাত্রীদের পাশের হার প্রায় ৮৫ শতাংশ৷ পাশ ও ফেল করা পরীক্ষার্থীর হিসেবেও অনেক পিছিয়ে ছাত্রীরা৷ গোটা রাজ্যে ৭৭ হাজার ২১৭ জন ছাত্রী ফেল করেছে৷ ছেলেদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৪৩ হাজারের কিছু বেশি৷ অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ৬৪ জন ছাত্রী ফেল করলে ৩৬ জন ছাত্র ফেল করছে৷ মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় প্রথম দশে জায়গা করে নিয়েছে ৬৬ জন শিক্ষার্থী৷ তাদের মধ্যে মেয়ে মাত্র ১২ জন৷

কন্যাশ্রী ও অন্যান্য প্রকল্প কী ফল দিচ্ছে?

রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পড়ুয়াদের সহায়তা দেয় পশ্চিমবঙ্গে৷ ইতিমধ্যে ৮৯ লক্ষ ছাত্রী রাজ্য সরকারের তরফে দেওয়া কন্যাশ্রী বৃত্তি পেয়েছে৷ একইরকমভাবে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের ‘ঐক্যশ্রী’ বৃত্তি দেওয়া হয়৷ এখনও পর্যন্ত ৪ কোটি ১৫ লক্ষ ছাত্রছাত্রী এই বৃত্তি পেয়েছেন৷ ‘শিক্ষাশ্রী’ প্রকল্পটি তফসিলি জাতির ছাত্রছাত্রীরা পেয়ে থাকে৷ ১ কোটি ৩৯ লক্ষ পড়ুয়া ওই বৃত্তি লাভ করেছে৷ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ‘মেধাশ্রী’ বৃত্তি রয়েছে৷ ৬ লক্ষ ৬৮ হাজার পড়ুয়া এই বৃত্তি পেয়েছে৷

প্রশ্ন উঠছে, এই সরকারি সামাজিক প্রকল্পগুলি থাকা সত্ত্বেও ছাত্রীরা সফল হতে পারছে না কেন?

পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. হরিদাস ঘটক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমার স্কুলে সকলেই পাশ করেছে৷ কিন্তু ছাত্রীরা আমার স্কুলেও খারাপ ফল করেছে৷ কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প দিয়ে হয়তো বাল্যবিবাহ আটকানো গিয়েছে, কিন্তু স্কুল চত্বরে ছাত্রীদের পড়াশোনামুখী করা যায়নি৷ দান, প্রকল্প বা ভাতা দিয়ে নয়, ছাত্রীদের স্কুলমুখী করতে হবে আকর্ষণীয় পঠনপাঠন দিয়ে৷”

অবশ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এত সংখ্যক ছাত্রী যে পরীক্ষা দিয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত তাদের শিক্ষার আগ্রহ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ রাজ্য সরকারের নানা সামাজিক প্রকল্প মেয়েদের আরও বেশি এগিয়ে দিচ্ছে৷”

কিন্তু তার বক্তব্য মানতে নারাজ বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা৷ কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন)-এর প্রধান শিক্ষক সায়ন্তন দাস বলেন, ‘‘শুধু সামাজিক প্রকল্প দিয়ে পড়ুয়াদের পড়াশোনা হয় না৷ অনায়াসে পাওয়া ভাতার বদলে পড়ুয়ারা কষ্ট করে সম্মানিক অর্জন করলে অর্থের মর্ম বুঝবে৷ তখন তাদের পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জনের তাগিদ জাগবে৷”

সমস্যা বেশি গ্রামাঞ্চলে

ইংরেজি মাধ্যম আইসিএসই, আইএসসি–র ফলাফলে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের পাশের হার বেশি ছিল এবারে৷ এই দুটি বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষায় কলকাতার দুই ছাত্রী দেবত্রী মজুমদার ও সৃজনী দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা স্থান পেয়েছে৷

অথচ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে ছবিটা উল্টো এবং জেলাভিত্তিক ছবিটা খুবই উদ্বেগের৷ উত্তর দিনাজপুরে ৩০ শতাংশ ছাত্রী ফেল করেছে৷ জলপাইগুড়ি, মালদা, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলায় ২০ শতাংশ বা তার বেশি ছাত্রী ফেল করেছে৷

শিক্ষকরা মনে করছেন এটি প্রধানত গ্রামাঞ্চলের সমস্যা৷ সায়ন্তন দাস বলেন, ‘‘আমরা যখন পড়াচ্ছি, দেখছি মেয়েরা ছেলেদের থেকে অনেক বেশি সিরিয়াস৷ তবে গ্রামের দিকে ছবিটা আলাদা৷ সেখানে মেয়েদের পড়াশোনার চল যে খুব বেড়ে গিয়েছে, এমনটা নয়৷ এখনো পর্যন্ত তাদেরকে দিয়ে গেরস্থালির পরিশ্রমের কাজ করানো হচ্ছে৷ এই স্টিগমা এখনো যায়নি৷”

তাছাড়া দীর্ঘদিন সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি৷ অনেক স্কুলে অংক ও বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ুয়া ভর্তির সংখ্যা কমেছে৷ তাই গ্রামাঞ্চলে যেখানে অভিভাবকরা সচেতন নন, সেখানে সমস্যা আরো বেড়েছে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে৷

সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জের কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে স্কুল অনেক বেশি ভরসার জায়গা৷ বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির জন্য৷ তাদের টিউশন নেওয়ার সামর্থ্য থাকে না৷ স্কুলগুলিতে গরমের ছুটি বা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষাকেন্দ্র হওয়া ইত্যাদি কারণ সমূহের জন্য একাডেমিক সময় কমে যাচ্ছে৷ পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে অংক এবং বিজ্ঞানের শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে৷ সেটা প্রাইভেট টিউশন নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে৷ এটার প্রভাব পড়ছে রেজাল্টে৷”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘‘আমাদের সমাজে মেয়েদের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য এখনো অতিক্রম করা যায়নি৷ তাই ছাত্রীদের জন্য অভিভাবকরা আলাদা করে টিউশনে আর খরচ করতে চান না৷ গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীদের ভালো জায়গায় টিউশন পড়ার জন্য যাতায়াতের ক্ষেত্রেও যে নিরাপত্তা দরকার, সেটা নেই৷ সেটাও ভালো টিউশন পাওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের বাধার মুখে ফেলছে৷ যেহেতু ছাত্ররা দূরে গিয়ে টিউশন নিতে পারছে, তারা এই বাধা অতিক্রম করছে৷ যেটা ছাত্রীরা পারছে না৷”

সমাধান কোথায়

হরিদাস ঘটক বলেন, ‘‘স্কুল চালাতে গিয়ে দেখেছি এখনকার ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা অনেক বেশি স্মার্টফোনকেন্দ্রিক৷ তার ফলে পঠনপাঠনে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে৷ বহু ছাত্রী ইদানীং অনুপস্থিত হচ্ছে৷ তারা অনেক বেশি প্রলোভনে পড়ে যাচ্ছে৷ স্মার্ট ক্লাস বা ক্লাসে উপস্থিতির জন্য পড়ুয়াদের ইনসেনটিভ ইত্যাদি দিলে তারা স্কুলমুখী হবে৷ লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্যারাটে, ফুটবল টিম তৈরি করে তাদের কর্মসূচির মধ্যে মনোনিবেশ করাতে হবে৷”

তিনি মনে করেন, ‘‘পিছিয়ে পড়া ছাত্রীদের পঠনপাঠনের জন্য সরকারকে আরো বেশি সচেতনতামূলক প্রকল্প হাতে নিতে হবে৷ তবে তাদের বিপথগামী হওয়া থেকে আটকানো যাবে৷”

শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘প্রতিযোগিতায় ছাত্রীরা সমান সুযোগ পেলে ছেলেদের থেকে অনেক ভালো করে৷ কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের সেই সুযোগ দেওয়া হয় না৷ এটা একটা সামাজিক সমস্যা৷ রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে বুঝতে হবে যে নারীদের অবহেলা করা উচিত নয়৷”

ডিডাব্লিউ ডটকম

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024