বিভুরঞ্জন সরকার
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা দ্বন্দ্ব হঠাৎ একদিনে যুদ্ধের দিকে গড়িয়ে পড়ে না। এর পেছনে থাকে অনেক কথা ও কাহিনি। দিনে দিনে নানা ঘটনায় বাড়ে অবিশ্বাস, প্রতিহিংসা ও দেখে নেওয়ার মানসিকতা। এর সঙ্গে রাজনীতির এক সূক্ষ্ম ও বিষাক্ত খেলা তো আছেই। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আবারো একটি পুরনো প্রশ্নকে সামনে এনেছে, এই উপমহাদেশ কি সত্যিই যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আর যদি যায়, তবে সেই যুদ্ধের পরিণতি কে কীভাবে বহন করবে? কে জিতবে আর কে হারবে? যুদ্ধে কী সত্যি কেউ জেতে? এ প্রশ্নগুলো যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক ও অস্তিত্বগত।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের কাশ্মীরের পহেলগাঁও অঞ্চলে একটি ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। ভারত সরাসরি এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামক এক অভিযানে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পাকিস্তান দাবি করে, এই হামলায় নারী ও শিশুসহ ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে নামায় এবং সীমান্ত অঞ্চলে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এই উত্তেজনা একধরনের খোলা সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে, যেটিকে কেউ কেউ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দেখছেন। দুই দেশের নীতিনির্ধারকেরা কী মাথাগরম আচরণ করবেন, নাকি শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন?
ভারত ও পাকিস্তান – দুটোই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ১৯৭৪ সালে ভারত এবং ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একে অপরকে চাপের খেলায় টেনে আনে। যুদ্ধ এখানে শুধু সীমান্ত দখল বা সামরিক জয় নয়—এটি অস্তিত্বের লড়াই হয়ে উঠতে পারে। কারণ একবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু হলে তার সীমা আর কোনো কূটনৈতিক কল্পনায় আটকায় না। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ, ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে হামলা, ২০০8-র মুম্বাই হামলা কিংবা ২০১৬ সালের উরির সেনাঘাঁটিতে হামলার পর পাল্টা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক—এই প্রতিটি ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, কিন্তু সর্বাত্মক যুদ্ধের দিক থেকে উভয় দেশ পিছিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো—এইবারের উত্তেজনা কি ব্যতিক্রম কিছু ঘটিয়েই ছাড়বে?
এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা আলাদা। একদিকে ভারত জাতীয়তাবাদী জনসাধারণের চাপে এবং আসন্ন নির্বাচনের কৌশলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতে চাইছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও সামরিক শক্তির প্রদর্শনী দিয়ে রাষ্ট্রীয় সংহতি বজায় রাখার চেষ্টা করছে। দুই দেশই নিজেদের জনগণের সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। রাজনৈতিক নেতারা ‘কঠিন প্রতিক্রিয়া’, ‘রক্তের বদলে রক্ত’ বা ‘চূড়ান্ত জবাব’ এর মতো বাগ্মীতায় ব্যস্ত, অথচ সীমান্তের গ্রামের কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন, পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে পারবো তো? কবে আসবে শান্তি?
যুদ্ধ কেউই চায় না—এটা অনেকটা যেন মুখরোচক বাণীর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা প্রায়ই যুদ্ধ চায় না বললেও যুদ্ধের প্রস্তুতিই কখনো কখনো যেন তাদের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের সামরিক বাজেট বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, পাকিস্তানও তার সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে পিছিয়ে নেই। যুদ্ধ-যন্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, গোয়েন্দা নজরদারি, সাইবার-হ্যাকিং, ড্রোন—সবই এখন প্রস্তুত।
যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে এর প্রথম শিকার হবে বেসামরিক মানুষ। যুদ্ধ মানেই সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষদের উদ্বাস্তু হওয়া, নারীদের ধর্ষণের আশঙ্কায় গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হওয়া, শিশুদের স্কুলে না যাওয়া, পুরুষদের সীমান্তে ধরে নিয়ে যাওয়া কিংবা মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারানো। এসব কথা আমরা পূর্বে জেনেছি শরণার্থী শিবিরে কান্না করা বৃদ্ধার কাছ থেকে, জানছি খোদ কাশ্মীরি মায়েদের মুখে, যারা জানে না তাদের সন্তান আর ফিরে আসবে কি না। আবার, মিডিয়ার পর্দায় যখন ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সফল’, ‘শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস’, ‘শত্রু শিবিরে আগুন’ শিরোনাম দেখি, তখন সাধারণ মানুষের আতঙ্ক বা হৃদয়বিদারক বাস্তবতা যেন কোনো পাতায় জায়গা পায় না। যুদ্ধ নিয়ে হয়তো এক ধরনের রোমান্টিকতা কেউ কেউ মনে পোষে, বাস্তবে তা হচ্ছে রক্ত, মৃত্যু আর ধ্বংসের অপার্থিব বেদনার অন্য নাম।
এই যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি কী? কেউ জিতবে কি? উত্তর কঠিন। হ্যাঁ, সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ভারত এগিয়ে। তাদের সেনা সংখ্যা বেশি, অস্ত্র উন্নত, প্রযুক্তি আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভিত্তি বেশি বিস্তৃত। পাকিস্তান কিছুটা বেশি প্রতিক্রিয়াশীল এবং দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও দীর্ঘদিন ধরে ‘আণবিক প্রতিরোধ’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। যদি যুদ্ধ প্রসারিত হয়, তবে পাকিস্তান শুরু থেকেই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা ইঙ্গিতে বলে এসেছে। আর ঠিক এখানেই গোটা পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়ংকর—কারণ পৃথিবীতে পরমাণু অস্ত্র চালু হয়ে গেলে, কে জিতল আর কে হারল—সে হিসাব আর কেউ করতে পারবে না।
আমরা যখন দুই দেশের যুদ্ধে সম্ভাব্য বিজয়ী খুঁজছি, তখন আমাদের উচিত আরও গভীর একটি প্রশ্ন করা—এই যুদ্ধ কেন? কিসের জন্য? কতজন মরবে? দুই দেশের ইতিহাসে কত যুদ্ধ হয়েছে, কত আন্দোলন, কত আত্মত্যাগ—কিন্তু কি ফল এসেছে? দু’পক্ষেই দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং শাসকদের মিথ্যাচারে জনগণের অসহায়ত্ব। সেখানে যুদ্ধ কি একটি বাস্তব সমাধান, না কি একটি কৃত্রিম উত্তেজনা তৈরি করে ভোট আর ক্ষমতার খেলা চালিয়ে যাওয়া?
আন্তর্জাতিক মহলও এখন কিছুটা বিভ্রান্ত। একদিকে আমেরিকা চাইছে ভারতকে পাশে রেখে চীনের বিরুদ্ধ বলয়ে শক্তি বাড়াতে, অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে জোট গড়ে তুলছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। এই জিও-পলিটিক্সের গোলকধাঁধায় সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব কীভাবে নষ্ট হচ্ছে, তা যেন কেউ দেখতে চায় না। জাতিসংঘ একাধিকবার দুই পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এ আহ্বান শুধু প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে থেকে যায়। যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তা হবে শুধুই দক্ষিণ এশিয়ার নয়, বরং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এক ভয়াবহ পরিণতি।
একটি প্রশ্নের জবাব কি কেউ দিতে পারেন—যারা যুদ্ধ চায়, তারা কি জানে যুদ্ধের মানে কী? তারা কি জানে একটা আকাশচুম্বী ক্ষেপণাস্ত্র যখন কোনো জনপদে পড়ে, তখন কেবল ঘরবাড়ি-স্থাপনা নয়, মানুষের জীবনও ধ্বংস হয়ে যায়? তারা কি জানে ‘শত্রু’ ভেবে যে মানুষের দিকে বন্দুক তাক করা হয়, সে-ও কারো বাবা, ভাই, প্রেমিক বা বন্ধু? মানুষহত্যার নৃশংসতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
যুদ্ধ আসলে একটি রাজনীতিক হঠকারিতা। শান্তি আসে কষ্টে, ত্যাগে, আলোচনায়, পরস্পর বোঝাপড়ায়। যারা যুদ্ধকে নিছক দেশপ্রেমের মহত্ত্ব বলে গলা ফাটান, তারা হয়তো জানেন না যে দেশপ্রেম মানে কেবল বর্ডারে মরে যাওয়া নয়, দেশকে রক্ষা করা—দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বৈষম্য, ঘৃণা, প্রতিহিংসা এবং মিথ্যার হাত থেকে। তাই ভারত-পাকিস্তান যদি সত্যিই সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়, যে লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তবে সেই যুদ্ধে শেষ বিচারে ভারত বা পাকিস্তান কারও জয় নয়, বরং মানবতার পরাজয় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
Leave a Reply