সায়েদ মুনির খসরু
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির হুমকি: অ্যালবেনিজের সামনে নতুন বাস্তবতা
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বড় জয় পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবেনিজ ও তার লেবার পার্টি। কিন্তু ক্ষমতায় ফেরার পরই তাকে সামলাতে হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক হুমকির ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এই প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়ার কূটনৈতিক দক্ষতা ও নিরাপত্তা কৌশল কতটা কার্যকর হবে তা সময়ই বলবে।
এপেক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য: এক নতুন সুযোগ
অস্ট্রেলিয়া এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (APEC)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দেশটি এখনও ‘পুত্রাজায়া ভিশন ২০৪০’-এর লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে এবং একটি মুক্ত আঞ্চলিক বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান (ASEAN) গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের চেয়েও বেশি—২০২৩-২৪ অর্থবছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৯৩ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার।
এই বাণিজ্য জোটের সঙ্গে সহযোগিতা আরও বাড়াতে অস্ট্রেলিয়াকে কাগজবিহীন বাণিজ্য ও শুল্ক প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, যা এপেকের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আসিয়ান সম্পর্ক জোরদার এবং ২০৪০ কৌশল
অস্ট্রেলিয়া ও আসিয়ানের বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাত প্রাধান্য পাচ্ছে—যেমন: সামুদ্রিক নিরাপত্তা, ডিজিটাল রূপান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ। পাশাপাশি, ‘সাউথইস্ট এশিয়া ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজি টু ২০৪০’-এর অধীনে অস্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি অস্ট্রেলিয়ান ডলার বিনিয়োগ করেছে অবকাঠামো, শিক্ষা ও সবুজ জ্বালানিতে।
চীন: অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ অর্থনৈতিক অংশীদার
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ‘অস্পর্শনীয়’ হলেও চীন রয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক সঙ্গী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের করোনা-উৎপত্তি তদন্ত চাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। তবে অ্যালবেনিজ ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয় এবং ২০২৪ সালের শেষে চীন সব বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এখন অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানির এক-চতুর্থাংশের বেশি চীনেই যাচ্ছে—প্রধানত লৌহ আকরিক, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস, গরুর মাংস ও ওয়াইন।
তবে নিরাপত্তা উদ্বেগ ও বিদেশি হস্তক্ষেপের শঙ্কা এখনো রয়েছে। একদিকে যেমন AUKUS ও Quad-এর মাধ্যমে নিরাপত্তা জোট জোরদার হচ্ছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা না বাড়ানোর দিকেও নজর রাখছে অস্ট্রেলিয়া।
বৈচিত্র্য আনতে হবে রপ্তানিতে
অস্ট্রেলিয়াকে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনতে হবে—বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও পরিষ্কার জ্বালানি খাতে। পাশাপাশি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগও বাড়াতে হবে। বর্তমানে চীনা শিক্ষার্থীরা অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ২২%। লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ‘সফট ক্যাপ’ থাকলেও চীনের ক্ষেত্রে কিছু নমনীয়তা প্রদর্শন জরুরি।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা
জাপানের সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তা ঘোষণা নবায়নের মাধ্যমে দুই দেশ সামরিক প্রশিক্ষণে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও ‘২+২’ মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপ চালু হয়েছে। ২০২৪ সালে কোরিয়ার AUKUS Pillar II-তে অংশগ্রহণ আগ্রহকে স্বাগত জানায় অস্ট্রেলিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি জাপান ও কোরিয়ার অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেললে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য সম্ভাবনাও কমে যেতে পারে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিজিটাল সেবা ও সবুজ প্রযুক্তি খাতে নতুন চুক্তি বাড়ানো প্রয়োজন।
ভারতের সঙ্গে অগ্রগতি, কিন্তু চুক্তি এখনো অসম্পূর্ণ
Quad-এর অংশ হিসেবে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়েছে। ২০২২ সালে দুদেশের মধ্যে প্রাথমিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য চুক্তি (ECTA) স্বাক্ষরিত হয়, যা অধিকাংশ পণ্যের ওপর শুল্ক উঠিয়ে দেয়। পরে CECA (Comprehensive Economic Cooperation Agreement) নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে নির্বাচনী কারণে এবং কৃষি ও সেবা খাতে মতানৈক্যের কারণে এটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
নন-টারিফ বাধা যেমন মানগত পার্থক্য ও অবকাঠামোগত ঘাটতি—বিশেষ করে কৃষি ও ওষুধ খাতে—বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাধা হয়ে রয়েছে।
ট্রাম্পের নীতি অস্ট্রেলিয়ার জন্য কতটা বিপজ্জনক?
ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসায় বৈশ্বিক কূটনীতির সমীকরণ আবারও বদলাতে পারে। অতীতে তার নীতিগুলো অস্ট্রেলিয়ার জন্য লাভজনক ছিল না—যেমন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (TPP) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা। তাই এখন সময় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কতটা যৌক্তিক, তা নতুনভাবে পর্যালোচনা করার।
দ্বিতীয় মেয়াদে কূটনৈতিক পরীক্ষা
অ্যান্থনি অ্যালবেনিজের দ্বিতীয় মেয়াদে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা। তার কূটনৈতিক দক্ষতার সত্যিকার পরীক্ষা এখন শুরু হলো।