সারাক্ষণ রিপোর্ট
নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতায় খাবারের কূটনীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে জটিল নিরাপত্তা পরিবেশের মুখে জাপান এখন বিদেশি নেতাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে পুরোনো এক কৌশলই বেছে নিয়েছে—মোক্ষম খাবারের আপ্যায়ন। প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা মনে করেন, ভোজসভা কেবল সৌজন্য নয়, বরং বাণিজ্য ও কৌশলগত আলোচনার দুয়ার খুলে দেয়।
ইশিবার আয়োজিত সাম্প্রতিক ভোজসভা
• মার্চে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আসা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সম্মানে পরিবেশিত হয় জাপানি স্ক্যালপ ও মিষ্টি আলু থেকে তৈরি শোচু—দুটি পণ্যই এখনো ব্রাজিল আমদানি করে না, যা বাণিজ্য সম্প্রসারণের বার্তা দেয়।
• দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ইশিবা সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন ও ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতেরি অরপোকে আলাদাভাবে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। টেবিলে ছিল ভূমিকম্প‑কবলিত নোতো অঞ্চলের আর নিজের বাড়ি তোত্তোরির পণ্য, যেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে উঠে আসার সাহস জোগানো যায়।
• টোস্টে জাপানি সাকে‑র পাশে সুইডিশ ও ফিনিশ মদও রাখা হয়—ইশিবার মতে, অতিথি দেশের পানীয়ে শুভেচ্ছা জানানোই ভদ্রতা।
ফিনিশ রাষ্ট্রদূতের অভিজ্ঞতা
রাষ্ট্রদূত তানিয়া ইয়াস্কেলাইনেন জানান, রঙিন ছোট ছোট পদের ধারাবাহিকতা অতিথিদের মুগ্ধ করেছে। কথোপকথনে নিরাপত্তা নীতি নিয়ে সরস আলোচনা হয়েছে, যা ইশিবার আজীবনের আগ্রহের বিষয়।
আবের আমলে ট্রাম্পকে ভিন্নধর্মী আপ্যায়ন
২০১৯ সালে ডনাল্ড ও মেলানিয়া ট্রাম্পের সফরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অভিজাত রোপ্পongi এলাকার এক রোবাস্তা‑ইয়াকি রেস্তোরাঁ বেছে নিয়েছিলেন। ফাস্ট ফুড‑প্রিয় ট্রাম্পের জন্য পরিপাটি কাইসেকির বদলে তুলনামূলক অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে জাপানি স্বাদ উপস্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। ট্রাম্প তৃপ্তির সঙ্গে বেকড পটেটো ও ওয়াগ্যু স্টেক উপভোগ করেন।
কেন খাবার গুরুত্বপূর্ণ সফট পাওয়ার
সাবেক রাষ্ট্রদূত কেনজিরো মনজি বলেন, কূটনৈতিক ভোজসভা তথ্য ও মতবিনিময়ের দুর্লভ সুযোগ; কোনো নেতাকে বাসভবনে নিমন্ত্রণ করলে মুহূর্তেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। জাপানি খাবারের সৌন্দর্য, উপস্থাপনা ও বৈচিত্র্য নিজেই আলোচনা শুরু করায় সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরণের পানীয়ের সাথে একে মেলানোও সহজ, যা খাবারকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
রাষ্ট্রদূতীয় রাঁধুনিরাই সম্মুখ সারির কূটনীতিক
বিদেশে জাপানের দূতাবাসগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা‑রাঁধুনিরা আনুষ্ঠানিক ভোজ, ব্যক্তিগত খাবার ও দূতাবাসের অনুষ্ঠান সামলান। বেইজিং‑এ জাপানি দূতাবাসের শেফ ইকুও হোরি জানান, “সামান্য হলেও রান্নার মাধ্যমে কূটনীতিতে অবদান রাখতে পারাই এই পেশার আনন্দ।”
• ২০২৩ সালে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শোধিত বর্জ্য জল ছাড়ার পর চীন জাপানি সামুদ্রিক খাদ্যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তবু চীনা ভোজনরসিকরা জাপানি মাছ চাইছেন—এই পরিস্থিতি দুই দেশেই ক্ষতির কারণ বলে হোরি মনে করেন।
• বিদেশে পদায়ন, দুর্বল ইয়েন ও কম ভাতা—এই তিন কারণে অভিজ্ঞ শেফের ঘাটতি রয়েছে।
নারী শেফের খোঁজ ও প্রতিযোগিতা
বার্সেলোনায় জাপানি কনসাল জেনারেল আকিকো শিকাতা দূতাবাসের আবাসিক পরিকল্পনায় একসঙ্গে থাকার বাধ্যবাধকতার কারণে নারী শেফ খুঁজছিলেন। জাপানি শেফদের মধ্যে নারী সংখ্যা এক শতাংশেরও কম, ফলে উপযুক্ত প্রার্থী পেতে দুই মাসের বেশি সময় লেগেছে।
দেশে বিদেশি পর্যটকের স্রোত বেড়ে যাওয়ায় শেফ‑সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাঁধুনিদের কাজের শর্ত উন্নত করার পরিকল্পনা নিচ্ছে।
জাপানের “সুশি কূটনীতি” প্রমাণ করেছে, শক্তিশালী অস্ত্র বা অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়াও খাবারের স্বাদ ও আতিথেয়তার আন্তরিকতা বিশ্বমঞ্চে সমান কার্যকর। স্থানীয় সংস্কৃতি আর বৈশ্বিক রুচির মেলবন্ধন করে টেবিলে বসানো গেলে আন্তঃরাজনৈতিক কথোপকথন যেমন প্রাণবন্ত হয়, তেমনি পারস্পরিক আস্থা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও বাড়ে।