সারাক্ষণ রিপোর্ট
২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ৬০ হাজার বেশি। এক বছর আগের এই সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেকার ছিল ২৫ লাখ ৫০ হাজার এবং এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা ছিল আনুমানিক ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ, গত ৯ মাসে প্রবল গতিতে বেকারত্ব বেড়েছে। বর্তমানে দেশের বেকারের হার ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যেখানে পুরুষ বেকার ১৮ লাখ এবং নারী বেকার ৮ লাখ ২০ হাজার।
এর পাশাপাশি দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজারে, যা গত বছরের তুলনায় ১৭ লাখ ২০ হাজার কম।
কেন বাড়ছে বেকারত্ব?
কারখানায় অস্থিরতা ও অগ্নিকাণ্ড
২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন শিল্প অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। মজুরি, ওভারটাইম ও ছাঁটাই ইস্যুতে বেশ কিছু গার্মেন্টস কারখানায় সংঘর্ষ, ধর্মঘট ও দাঙ্গা হয়। কয়েকটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যার ফলে স্থায়ীভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় ও হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারান।
তথ্য বিভ্রাট ও ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, তারা সরকারের কাছ থেকে যথাযথ নীতিগত নির্দেশনা ও তথ্য পাচ্ছেন না। হঠাৎ কর নীতি বা আমদানি-রপ্তানি নির্দেশনায় পরিবর্তন হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
বিদ্যুৎ সংকটে ছোট শিল্প ধুঁকছে
গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে। দৈনিক ৫-৭ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কোটা আন্দোলন এবং ক্ষমতার পরিবর্তন দেশের ব্যবসা ও শিল্প খাতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সহিংসতা ও বিক্ষোভের কারণে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় বা উৎপাদন সীমিত করে।
শিক্ষা ও দক্ষতার অমিল
উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বিশাল একটি অংশ শিল্পপ্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
অঞ্চলভিত্তিক বেকারত্বের চিত্র
বিবিএস-এর তথ্যমতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলিতে (যেমন: কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রংপুর, দিনাজপুর) বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। এর কারণ ওইসব অঞ্চলে:
- কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি বেশি নির্ভরশীল
- শিল্পায়নের হার কম
- শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সুযোগ সীমিত
অন্যদিকে, ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্প থাকলেও সাম্প্রতিক সহিংসতা ও আগুনে ক্ষয়ক্ষতির কারণে শ্রমিক ছাঁটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের প্রভাব
গ্রামাঞ্চল থেকে শহরমুখী অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের হার গত এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অভিবাসন প্রক্রিয়ায়:
- শহরে কর্মসংস্থানের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়নি
- বসবাস, খাদ্য ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে জীবিকা কঠিন হয়েছে
- বস্তির সংখ্যা ও জনঘনত্ব বেড়েছে, যার ফলে সামাজিক সমস্যা বাড়ছে
- অভিবাসী তরুণদের অনেকেই বেকার থেকে যায় এবং অপরাধ বা অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে
স্থিতিশীল সরকার
বিশ্লেষকদের মতে, একটি দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর সরকার:
- নীতিগত ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে
- বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারে
- সহিংসতা দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম
- বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোতে টেকসই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারে
করণীয় ও সুপারিশ
কারিগরি ও বাজারমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা
ব্যবসায়ীদের জন্য তথ্য-ভিত্তিক পরামর্শ সেবা তৈরি করা
এসএমই-খাতে সহজ শর্তে ঋণ ও বিদ্যুৎ নিশ্চয়তা প্রদান করা
প্রতিটি জেলায় শিল্প জোন গঠন ও কর্মসংস্থান কেন্দ্র চালু করা
রাজনৈতিক সংলাপ ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বেকারত্ব হ্রাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যদি এখনই কার্যকর নীতিগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগামী বছরগুলোতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।