সারাক্ষণ রিপোর্ট
ভারতের হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা — স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের আমদানি বন্ধ
২০২৫ সালের ১৭ মে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড’ (DGFT) এক নির্দেশনায় জানায়, বাংলাদেশ থেকে আসা তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী এবং কাঠের আসবাবপত্রসহ বেশ কিছু পণ্য আর স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে না। এখন থেকে এসব পণ্য শুধুমাত্র কলকাতা ও নাভা শেভা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে ঢুকবে।
বেনাপোলে আটকে পড়েছে কোটি টাকার পণ্য
নতুন এই নিষেধাজ্ঞার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে বেনাপোল স্থলবন্দরে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৫.৫ কোটি টাকার তৈরি পোশাক বোঝাই ৩৬টি ট্রাক আটকে আছে, যেগুলো পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায়। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির ৯৩ শতাংশই স্থলপথে হয়, যার বেশির ভাগই বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে যায়। ফলে এই নিষেধাজ্ঞা সরাসরি বড় ধাক্কা দিয়েছে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর।
ভারতীয় শিল্পের লাভ, ভোক্তাদের উদ্বেগ
ভারতের স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের মতে, এতে দেশীয় উৎপাদকরা বাড়তি বাজার পাবে এবং প্রায় ১,০০০ কোটি রুপির ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে। তবে বিপরীতে, কিছু ব্র্যান্ডেড পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যার ফলে শীত মৌসুমে এসব পণ্যের দাম ২–৩ শতাংশ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানিতে বড়সড় ধাক্কা
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GTRI) জানিয়েছে, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হারাতে পারে, যা দুই দেশের মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রায় ৪২ শতাংশ। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের পরিবর্তে চীন বা ভিয়েতনামের মতো বিকল্প বাজারে উৎপাদন সরিয়ে নিতে পারে, যা দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রাণ গ্রুপের ক্ষতি ও প্রতিক্রিয়া
নিষেধাজ্ঞার ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যসমূহে নিয়মিতভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করে আসছে, যা মূলত আখাউড়া-আগরতলা, শেওলা-শিলচরসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করে।
প্রাণ গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে অন্তত ২০০টির বেশি কন্টেইনার আটকে গেছে বিভিন্ন স্থলবন্দরে, যা কোটি কোটি টাকার পণ্যে পরিপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সমুদ্রপথে এসব অঞ্চলে পণ্য পাঠানো প্রায় অসম্ভব, কারণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারে প্রবেশের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম ছিল স্থলপথ।
প্রাণ গ্রুপের এক নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “আমরা গত দুই দশক ধরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যবসা করে আসছি। এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় নয়, বরং দীর্ঘদিনের বাজার ও ভোক্তা আস্থার ওপর সরাসরি আঘাত।”
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার সম্ভাবনা
ভারতের এই পদক্ষেপকে কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। অনেকের মতে, এটি বাংলাদেশের আন্তবর্তী ব্যবস্থার পররাষ্ট্রনীতি ও ভারতের কিছু রপ্তানি পণ্যের ওপর বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার প্রতিক্রিয়ায় এসেছে। ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নিষেধাজ্ঞার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং বলছে, ভারতীয় বাজারে এসব পণ্যের বিকল্প রয়েছে।
আলোচনার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ককে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের বাধ্য হয়ে সমুদ্রপথে রপ্তানি করতে হচ্ছে, যার ফলে পরিবহন ব্যয় ও সময় বেড়েছে। এই পরিস্থিতি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখন সময় দুই দেশকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটার, যাতে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হয় এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।