সারাক্ষণ রিপোর্ট
সামরিক দমন-পীড়নের কারণে উদ্বাস্তু মিয়ানমারবাসী ছড়িয়ে পড়ছে এশিয়ার নানা দেশে
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের দমন করতে কঠোর অভিযান চালানোয় লাখো মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। একদিকে যেখানে নারী ও শিশুদের একটি বড় অংশ নিরাপত্তার আশায় আশ্রয় খুঁজছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের বহু সবল, কর্মক্ষম যুবক ও তরুণ প্রতিবেশী দেশগুলোতে গিয়েও নানা ধরনের সামাজিক, নিরাপত্তাজনিত এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের সীমান্তে নতুন চাপ: পার্বত্য অঞ্চল ও নাইকোংছড়িতে অস্থিরতা
বাংলাদেশের কক্সবাজার, বান্দরবান, নাইকোংছড়ি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তজুড়ে ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা সঙ্কট বিদ্যমান। তার মধ্যে নতুন করে মিয়ানমারের সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষের ফলে সশস্ত্র ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ এবং গোলাগুলির ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, মিয়ানমারের একাধিক জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্য ও সেনাবাহিনীর পালিয়ে আসা সদস্যরা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। তারা কখনো আশ্রয়প্রার্থী সেজে মানবিক সহায়তা নিচ্ছে, আবার কখনো অস্ত্র ও মাদক পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।

মিয়ানমার থেকে আসা কর্মক্ষম তরুণরা অন্য দেশেও বিশৃঙ্খলার কারণ
জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার মিয়ানমারের তরুণ এখন কাজের খোঁজে দেশটিতে ঢুকছে। অনেকেই সৎভাবে জীবন গড়ার চেষ্টা করলেও, কর্মসংস্থান ও ভাষাজনিত সমস্যার কারণে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে বা হয়ে পড়ছে চরমপন্থার দিকে ধাবিত।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে, কেউ কেউ আবার পরিচয় গোপন করে আশ্রয় নিচ্ছে এবং স্থানীয় সমাজে সামাজিক সংঘাত তৈরি করছে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা: অস্ত্র পাচার ও বিদ্রোহী ঘাঁটি
বিশেষ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কিছু সবল মিয়ানমার তরুণ একাধিকবার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকাগুলোকে তারা অস্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে, এমন অভিযোগও উঠেছে।
এতে করে শুধু সীমান্ত নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নিরাপত্তা হুমকির নতুন ধারা তৈরি হচ্ছে। অস্ত্র, গুলি, মাদক ও বিস্ফোরক পাচারের ঘটনা বাড়ছে, যার পেছনে মিয়ানমার থেকে আসা এই সবল, অপ্রতিরোধ্য যুবাদের অংশগ্রহণ ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার ভার ও মানবিক সহনশীলতা চূড়ান্ত সীমানায়
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছে। এসব শরণার্থীর মধ্যে চাকরি করার অনুমতি নেই, ফলে তারা স্থানীয় শ্রমবাজারে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে, কম মজুরিতে কাজ করছে এবং স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে সংকট সৃষ্টি করছে।
এর ফলে কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে এবং মিয়ানমার থেকে আসা প্রত্যেক নতুন মুখই এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।

আঞ্চলিক কূটনীতি ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার সরকারের সামরিক আগ্রাসন শুধু দেশটির ভেতরেই নয়, বাইরেও একপ্রকার ‘মানবিক আগ্রাসনের’ সৃষ্টি করছে। হাজারো উদ্বাস্তু, যারা কোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অধীনে নেই, তারা এখন কার্যত পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের জন্য এই সংকট এখন দ্বিমাত্রিক—একদিকে মানবিক দায়, অন্যদিকে নিরাপত্তা রক্ষা। কিন্তু সীমিত সম্পদ ও দীর্ঘদিন ধরে চলা রোহিঙ্গা সঙ্কটের চাপে বাংলাদেশ কতদিন এই ভার বহন করতে পারবে, তা এখন বড় প্রশ্ন।
মিয়ানমারের সংকট আর শুধু মিয়ানমারের নয়
মিয়ানমার শুধু নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—তাদের সংকট এখন ছড়িয়ে পড়ছে গোটা অঞ্চলে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ভারত থেকে শুরু করে জাপান পর্যন্ত এই সঙ্কটের অভিঘাত স্পষ্ট।
বিশেষ করে মিয়ানমারের কর্মক্ষম, সবল, তরুণ গোষ্ঠী, যারা দেশ থেকে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে ঢুকছে—তারা অর্থনীতিতে যেমন চাপ দিচ্ছে, তেমনি নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্যকেও বিঘ্নিত করছে।
এই বাস্তবতা আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং নতুন কূটনৈতিক কৌশলের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করে তুলেছে। এখন প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে থাকলেও, গোটা অঞ্চল কতদিন তাদের ছায়ায় চাপা পড়ে থাকবে?
Sarakhon Report 



















