কক্সবাজার, বাংলাদেশ —বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের টিনের ছাউনির নিচে চলছে এক নিঃশব্দ যুদ্ধ—শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, বরং একটি প্রজন্মের আত্মার জন্য। হাজার হাজার কিশোর রোহিঙ্গা ছেলের জন্য কক্সবাজারের শিবিরগুলো মিয়ানমারের সেনা অভিযানের হাত থেকে পালানোর আশ্রয়স্থলই শুধু নয়; এই জায়গাগুলো এখন পরিণত হয়েছে হতাশার আঁতুড়ঘরে—কিছু ক্ষেত্রে উগ্রপন্থার জন্মভূমিও।
অস্পষ্ট জীবনের আবদ্ধতা
পনেরো বছর বয়সী আনোয়ার (ছদ্মনাম) ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে পালানোর পর আর কখনো শ্রেণিকক্ষ দেখেনি। সে দিন কাটায় অস্থায়ী চায়ের দোকানে বসে আর সরু গলিতে ক্যারম খেলে। “আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। এখন শুধু পালাতে চাই,” বলে সে এক নিস্তেজ দৃষ্টিতে। তার কথা প্রতিধ্বনিত করে বহু রোহিঙ্গা কিশোরের কণ্ঠে, যারা বেড়ে উঠেছে গাদাগাদি করা শিবিরে—নেই কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, নেই বৈধ কর্মসংস্থান, নেই কোনো ভবিষ্যতের আশা।
নিয়োগের ফাঁদ
এই শূন্যতাকেই কাজে লাগাচ্ছে উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলো। স্থানীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) এবং অন্যান্য আন্তর্জতিক উগ্রপন্থি নেটওয়ার্কগুলো নিঃস্ব, হতাশ কিশোরদের নিয়োগ দিচ্ছে নীরবে—প্রলোভন দেখানো হচ্ছে অর্থ, পরিচয়, এবং ক্ষমতার। কেউ কেউকে পাঠানো হয় কাছাকাছি জঙ্গলে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য, আবার কাউকে ব্যবহার করা হয় বার্তা বহন, লজিস্টিকস বা গুপ্তচর হিসেবে।
“কিশোররা সহজ লক্ষ্যবস্তু। তারা ক্ষুব্ধ, বেকার এবং ব্যবস্থার কাছে অদৃশ্য,” বলেন উখিয়ায় কর্মরত এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। “নিয়োগকারীরা তাদের ভাষাতেই কথা বলে—অবিচার ও প্রতিশোধের ভাষা।”
ছায়া নেটওয়ার্ক ও ভয়ের শাসন
বাসিন্দারা জানান, শিবিরের কিছু অংশ কার্যত সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী মত দমন করা হয়। যারা নিয়োগে রাজি হয় না বা মুখ খুলে, তাদের হুমকি দেওয়া হয় বা হত্যা করা হয়। গত এক বছরে একাধিক রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন, যাদের হত্যাকারীদের সঙ্গে ARSA-র সম্পৃক্ততা সন্দেহ করা হচ্ছে।
শিবির কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক এনজিওর সহায়তায় টহল এবং উগ্রপন্থা বিরোধী উদ্যোগ বাড়িয়েছে, কিন্তু সমস্যার ব্যাপ্তি এখনো ভয়ংকর।
শিক্ষা ও সম্পৃক্ততার ঘাটতি
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিবিরের অর্ধেকের বেশি রোহিঙ্গা কিশোর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষা বা কারিগরি প্রশিক্ষণ না থাকায় বহু কিশোর অপরাধচক্র, মাদক ব্যবসা কিংবা আরও ভয়াবহ জগতে জড়িয়ে পড়ছে।
“আমাদের স্কুল দিন, আমাদের আশা দিন,” আকুতি করে আনোয়ার, যে জানায় সম্প্রতি একটি ‘ছোট কাজের’ জন্য ১০ হাজার টাকা প্রস্তাব পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
একটি সময়ের বিস্ফোরণ
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন, যদি দ্রুত ও ধারাবাহিক হস্তক্ষেপ না করা হয়, তবে রোহিঙ্গা কিশোরদের উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়া কেবল শিবির নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। “আমরা একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি,” বলেন ঢাকাভিত্তিক এক সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষক। “বিশ্বকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো হতাশা পরিণত হবে বিপদে।”
আনোয়ার এবং তার মতো অনেকের জন্য শরণার্থী শিবির মানে শুধু অনিশ্চয়তা। নৃশংস অতীত আর হতাশ ভবিষ্যতের মাঝে আটকে থাকা এই কিশোররা এখন সেই সব শক্তির কাছে অসহায়, যারা তাদের হতাশাকে কাজে লাগাতে চায়। তারা স্কুলে যাবে না উগ্রপন্থিদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে—তা নির্ভর করছে শুধু স্থানীয় নীতির ওপর নয়, বৈশ্বিক সদিচ্ছার ওপরও।