শুরুর গল্প: ছোটবেলার স্বপ্ন দেখা এক মেয়ের পথচলা
নুসরাত ফারিয়া মজুমদার—বাংলাদেশের বিনোদন জগতের এক উজ্জ্বল নাম। একজন গুণী অভিনেত্রী, টেলিভিশন উপস্থাপক, গায়িকা ও মডেল হিসেবে তিনি তার প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। ঢাকার চেনা-জানা পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই তরুণী কিশোরী বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখতেন আলো ঝলমলে পর্দায় নিজেকে মেলে ধরার।
নুসরাত ফারিয়ার জন্ম ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে, চট্টগ্রামে। যদিও তাঁর শৈশব ও পড়াশোনার বড় একটি অংশ কেটেছে ঢাকায়। ছোট থেকেই ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গান, নাচ, বিতর্ক—সব ক্ষেত্রেই ছিল তার দখল। এসব আগ্রহই এক সময় তাকে বিনোদনের মূলধারায় নিয়ে আসে।
শিক্ষাজীবন: পড়াশোনায়ও সাফল্যের ছাপ
নুসরাত ফারিয়া পড়াশোনায়ও ছিলেন মনোযোগী। তিনি কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু। পরবর্তীতে তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং তারপর লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ (LCLS) থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
আইনের শিক্ষার্থী হলেও তিনি সবসময়ই নিজেকে ক্যামেরার সামনে দেখতে চেয়েছেন। ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি মিডিয়ায় নিজের অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যান।
কর্মজীবনের শুরু: উপস্থাপনায় আত্মপ্রকাশ
নুসরাত ফারিয়ার মিডিয়াজগতে যাত্রা শুরু হয় রেডিও জকি হিসেবে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে চ্যানেল আইয়ের ‘আইডিয়াল মোমেন্ট’ এবং ‘সেরা নাচিয়ে’-এর মত রিয়েলিটি শোতে উপস্থাপনা করে আলোচনায় আসেন। তার স্মার্ট প্রেজেন্টেশন, ঝরঝরে উচ্চারণ এবং ক্যামেরার সামনে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ উপস্থিতি তাকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে।
রূপালী পর্দায় অভিষেক: ‘আশিকী‘ দিয়ে বাজিমাত
নুসরাত ফারিয়ার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ২০১৫ সালে কলকাতার প্রযোজনা সংস্থা এসকে মুভিজ প্রযোজিত ‘আশিকী’ ছবির মাধ্যমে। ছবিটি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি রীতিমতো নজর কেড়ে নেন। চিত্রনায়ক অঙ্কুশ হাজরার বিপরীতে এই ছবিতে অভিনয় করে দুই বাংলাতেই পরিচিতি পান।
‘আশিকী’ মুক্তির পর নুসরাত ফারিয়ার প্রতি নির্মাতাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। একে একে ‘হিরো ৪২০’, ‘বাদশা: দ্য ডন’, ‘বস ২’, ‘ডিটেকটিভ’, ‘ঢাকা ২০৪০’, ‘শাহেনশাহ’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’সহ একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে।
গান ও মডেলিং: বহুমুখী প্রতিভার প্রকাশ
শুধু অভিনয় নয়, গানেও নিজেকে মেলে ধরেছেন নুসরাত ফারিয়া। ২০১৮ সালে ‘পটাকা’ শিরোনামে নিজের প্রথম একক গান প্রকাশ করেন তিনি। গানটি ইউটিউবে ভাইরাল হয়। এরপর ‘আমি চাই থাকতে’, ‘হাবিবি’, ‘ভয় পাওনা’ প্রভৃতি গান প্রকাশ পায় এবং তার গায়কী নিয়ে যেমন প্রশংসা হয়েছে, তেমনি সমালোচনাও এসেছে।
মডেলিং জগতে নুসরাত ফারিয়া নিয়মিত কাজ করেছেন। ফ্যাশন শো, ব্র্যান্ড প্রোমোশন, টিভিসি—সবখানেই তার উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায়।
বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয়: নাটকীয় থেকে অ্যাকশন
নুসরাত ফারিয়ার অভিনীত চরিত্রগুলো বৈচিত্র্যে ভরপুর। কখনও রোমান্টিক প্রেমিকা, কখনও অ্যাকশন হিরোইন, কখনও রহস্যময় গোয়েন্দা—প্রতিটি চরিত্রে নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এ তার অ্যাকশনধর্মী অভিনয় দর্শকের দৃষ্টি কেড়েছে। অন্যদিকে, ‘ঢাকা ২০৪০’-এ তাকে এক কল্পনাপ্রসূত ভবিষ্যতের চিত্রে দেখা গেছে, যা তার অভিনয় দক্ষতার আরেকটি প্রমাণ।
ব্যক্তিগত জীবন: ক্যারিয়ার ও সম্পর্কের সমন্বয়
নুসরাত ফারিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও ভক্তদের কৌতূহল কম নয়। ২০২০ সালে তিনি জানান, দীর্ঘদিনের বন্ধু ও ব্যবসায়ী রনি রশীদের সঙ্গে তার বাগদান হয়েছে। যদিও ২০২১ সালে দুজনেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বেশি খোলামেলা না হলেও, তিনি সবসময়ই বলেছেন—কাজের প্রতি অঙ্গীকারই তার কাছে প্রাধান্য পায়।
অন্যান্য শখ ও আগ্রহ
নুসরাত ফারিয়া একজন নিয়মিত পাঠক। ফিকশন এবং আত্মজীবনীমূলক বই পড়তে পছন্দ করেন। এছাড়া তার শখের তালিকায় রয়েছে ভ্রমণ, রান্না, এবং ফিটনেস। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি সক্রিয় এবং নিয়মিতই ভক্তদের সঙ্গে নিজের কাজ, মতামত, এবং ব্যক্তিজীবনের খণ্ডচিত্র শেয়ার করেন।
সামাজিক বার্তা ও ভাবনা
নুসরাত ফারিয়া নারীর ক্ষমতায়ন, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং আধুনিক শিক্ষার পক্ষে সোচ্চার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা ও আলোচনায় তাকে দেখা যায়। তিনি বিশ্বাস করেন—একজন নারী যদি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন, তবে কোনও কিছুই তাকে আটকাতে পারে না।
নুসরাত ফারিয়া মানেই বহুমাত্রিক প্রতিভার সংমিশ্রণ
নুসরাত ফারিয়া আজ শুধুমাত্র একজন অভিনেত্রী নয়, একজন প্রেরণাদায়ী নারীও। বিনোদন জগতে তার কর্মদক্ষতা, সাহসী সিদ্ধান্ত, এবং বহুমুখী প্রতিভা তাকে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, পড়াশোনা, শৈল্পিকতা ও ক্যারিয়ার—সবকিছুর সমন্বয় করেই একজন নারী এগিয়ে যেতে পারেন আলোয় ভরপুর পথের দিকে।