বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলে নতুন যোগ দেওয়া অনেক দরিদ্র তরুণ-তরুণী শুরুতেই “কোনোভাবে টাকা তুলতে হবে” মানসিকতায় ঝুঁকে পড়ে। এটি শুধু নৈতিক প্রশ্ন নয়;পেছনে রয়েছে দারিদ্র্যের “স্কার্সিটি মাইন্ডসেট”,পারিবারিক চাপ,পৃষ্ঠপোষক রাজনীতির কাঠামো ও নীচ-সংস্কৃতিগত পরিবেশে বেড়ে ওঠা। নিচে এসব মনস্তাত্ত্বিক চালিকা শক্তি বিশ্লেষণ করা হলো।
দারিদ্র্যের মানসিক ছাপ: স্কার্সিটি মাইন্ডসেট
- দারিদ্র্য টেকসই উদ্বেগ ও অভাববোধ জাগায়; এতে মস্তিষ্ক তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির দিকে তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়ে,দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দুর্বল হয়।
• অভাবের অভিজ্ঞতা সিদ্ধান্তক্ষমতা, সহমর্মিতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ কমিয়ে অসৎতা বা ঝুঁকিপূর্ণ পথে ঝোঁক বাড়ায়।
পরিবার ও সামাজিক প্রত্যাশার চাপ
- নগর দরিদ্র পরিবারের ওপর চালানো একটি মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণা দেখায়, অর্থকষ্টজনিত উদ্বেগ ও বিষণ্নতা তরুণদের“আয় না বাড়ালে টিকে থাকতে পারব না” অনুভূতি প্রবল করে।
• ব্র্যাকের জাতীয় যুব জরিপে দরিদ্র তরুণদের প্রধান জীবন লক্ষ্য ছিল শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা ও সম্পদ জমানো—উভয়ই দ্রুত টাকার প্রয়োজনীয়তা বাড়ায়।
আপেক্ষিক বঞ্চনা ও সামাজিক তুলনা
- শহর-গ্রামে আয়ের বড় ফারাক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলমান ভোগ‑সংস্কৃতি দরিদ্র তরুণদের মধ্যে“অপরের সমান হতে হলে এখনই টাকা চাই” মনোভাব তৈরি করে, যা রাজনীতি‑ঘনিষ্ঠ লভ্য সুযোগকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
পৃষ্ঠপোষকতা ও ‘লো টু হাই’ মডেল
- বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্যাট্রন‑ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্ক এবং অবাধ পার্টি‑সুবিধা পেতে হলে নেতাদের খরচ জোগাতে হয়; পরিবর্তে পদ, সুযোগ ও চাকরি মেলে—এই ব্যবস্থায় টাকা তুলতে পারা সফলতার পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
• তরুণ নেতৃত্ব যাচাই‑বাছাইয়ে ঘুষ ও‘চাঁদা তোলার’ সংস্কৃতি অর্থলোভী মনোস্থিতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
ক্ষমতা সনাক্তকরণ ও শ্রেণি উত্থান
- ক্ষমতার সঙ্গে দৃশ্যমান সমৃদ্ধি জুড়ে গেছে; ফলে রাজনৈতিক পদ = সামাজিক মর্যাদা + অর্থ—এই সমীকরণ দরিদ্র তরুণদের দ্রুত আর্থিক উত্থানকে বৈধ বলে মনে করায়।
• একটি পত্রিকায়প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দীর্ঘদিনের পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে ‘মেধাভিত্তিক’ সিস্টেমের দাবি উঠলেও বাস্তবে আর্থিক পুরস্কারনির্ভর সংস্কৃতি বদলায়নি।
মনস্তাত্ত্বিক পুঞ্জীভূত স্ট্রেস ও ঝুঁকি গ্রহণ
দারিদ্র্যের দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস কর্টিসল বাড়িয়ে দেয়; এতে তাৎক্ষণিক লাভের ঝুঁকি গ্রহণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। নগদসংকটাপন্ন তরুণরা রাজনীতিতে জোগাড় করা তহবিল, কমিশন ও ঠিকাদারি ভিত্তিক আয়ের পথ বেছে নেন।
দারিদ্র্যসৃষ্ট স্কার্সিটি, পারিবারিক চাপ ও পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক কাঠামো মিলিয়ে দরিদ্র তরুণ‑তরুণীদের রাজনীতিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ আহরণকে প্রধান লক্ষ্য করে তোলে। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া এই প্রবণতা থেকে বের হওয়া কঠিন। নীতিনির্ধারকদের এখনই উদ্যোগ না নিলে নতুন প্রজন্ম আবারও পুরোনো দুষ্টচক্রে আটকে যাবে—রাজনীতি হবে অর্থ কামাইয়ের শর্টকাট, সেবামুখী নেতৃত্বের পথ নয়।