২০২৩‑এর মাঝামাঝি ঋণসুদের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বাঁধা তুলে নেওয়ার পর থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণ‑আমানত সুদব্যবধান (স্প্রেড) দ্রুত চওড়া হয়েছে। মার্চ ২০২৫‑এ সামগ্রিক স্প্রেড ৫.৮৭ শতাংশে পৌঁছায়, যা ২০২৩‑এর জানুয়ারিতে মাত্র ২.৯৫ শতাংশ ছিল।
সুদের বর্তমান চিত্র
- গড় আমানত সুদহার মার্চে দাঁড়ায় ৬.১৭ শতাংশ, আর ঋণসুদ ১২.০৪ শতাংশ।
- নন‑ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) একই সময় স্প্রেড ৩.১৮ শতাংশে নেমে আসে, ফলে ব্যাংক ও এনবিএফআই‑এর আয় ব্যবধান আরও বেড়েছে।
দুই বছরে কেন এত বৃদ্ধি
২০২৩ জুলাইয়ে ‘স্মার্ট’ সূচক (ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হার) চালু করে বাজারভিত্তিক ঋণমূল্য নির্ধারণের পথ নিলে ঋণসুদ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একই সময়ে আমানত সংগ্রহে প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ায় আমানত সুদও লাফিয়ে ওঠে, ফলে স্প্রেড প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
ব্যাংক ও নন‑ব্যাংক ব্যবধান
ব্যাংকের স্প্রেড যেখানে ৫.৮৭ শতাংশ, সেখানে এনবিএফআই‑এ তা ৩.১৮ শতাংশ। কারণ, এনবিএফআই‑কে আমানতের জন্য দ্বিগুণের বেশি (১০.৬১ শতাংশ) সুদ দিতে হয়, অথচ ঋণসুদে বাড়তি মার্জিন তুলনামূলক কম।
আমানত সংগ্রহের দৌড় ও উচ্চ সুদ অফার
নগদ সংকট সামাল দিতে অন্তত ১২টি ব্যাংক তিন মাস মেয়াদি স্থায়ী আমানতে ১১‑১১.৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে, যা আমানতকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও ব্যাংকের তহবিল‑ব্যয় বাড়াচ্ছে।
অনাদায়ী ঋণের বাড়তি চাপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সতর্কতায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে অনাদায়ী ঋণ (এনপিএল) জুন ২০২৫‑এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে আয়ের বড় অংশই প্রভিশনে আটকে যাচ্ছে।
নীতি‑পরিবর্তনের ভূমিকা
- স্মার্ট সূচক ৭ শতাংশের বেশি থাকায় নতুন ঋণ চুক্তিতে উচ্চ ভিত্তিমূল্য নির্ধারিত হচ্ছে।
- কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি‑সুদ ৪ শতাংশেই রেখেছে, কিন্তু বাজারসুদ বেড়ে গেছে, ফলে ব্যাংকের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ফুলে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক তুলনা
ভারতে মার্চ ২০২৫‑এ ব্যাংক স্প্রেড নেমে ২.৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে—ডিকেডের সর্বনিম্ন। সুদ কমাতে রিজার্ভ ব্যাংক পরপর রেপো রেট কেটেছে।
শ্রীলঙ্কায় রাতারাতি নীতি‑সুদ ৮ শতাংশে স্থির রেখে ঋণসুদ নামিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সক্রিয়, ফলে বাজারসুদ দ্রুত কমছে।
ঝুঁকি মূল্যায়ন: কে পাচ্ছে লাভ, কে দিচ্ছে মূল্য
- ঋণগ্রহীতা: উচ্চ সুদে উৎপাদন ও ভোক্তা ঋণের চাপ বাড়ছে; এসএমই‑এর অর্থায়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
- আমানতকারী: কাগজে লাভ বেড়েছে, কিন্তু ৯‑১০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতে প্রকৃত রিটার্ন খুব বেশি বাড়ছে না।
- ব্যাংক: স্বল্পমেয়াদে ভারী সুদ আয়; তবে উচ্চ এনপিএল ও তহবিলব্যয়ের কারণে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে।
করণীয়
স্প্রেডে ঊর্ধ্বসীমা বিবেচনা: নীতি‑নির্ধারকেরা ৫ শতাংশের বেশি স্প্রেড রোধে নরমালাইজেশন রূপরেখা দিতে পারেন।
এনপিএল ব্যবস্থাপনা জোরদার: দ্রুত বকেয়া পুনর্গঠন ও সম্পদ পুনরুদ্ধার ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করতে হবে।
প্রতিযোগিতা বাড়ানো: ডিজিটাল ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের বিকল্প সহজলভ্য করলে আমানত‑ঋণ বাজারে ভারসাম্য আসবে।
স্মার্ট ফর্মুলা পুনর্মূল্যায়ন: বাজারসভার অস্থিরতা কমিয়ে ঋণমূল্যে স্থিতিশীলগতি আনতে প্রয়োজন হলে ওজনে সমন্বয়।
স্প্রেড ৫‑৬ শতাংশে স্থায়ী হলে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়বে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি পুঞ্জীভূত হবে। তাই সুদবৈষম্য ৪‑৪.৫ শতাংশে নামাতে যুগপৎ মুদ্রানীতি, এনপিএল‑দমন এবং বাজার‑প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে—নয়নাভিরাম মুনাফার নিচে যে ছদ্মঝুঁকি জমা হচ্ছে, তা কমাতে এ পদক্ষেপ জরুরি।