বরিস জনসনের প্রত্যাবর্তনের গুঞ্জন
যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। একদা “বিগ ডগ” নামে পরিচিত জনসনকে কেউ তুলনা করছেন “জায়ান্ট টোড” বা “বুলেটপ্রুফ গানারসরাস” নামক ফুটবল মাসকটের সঙ্গে। আবার কেউ বলছেন, “বড় স্বর্ণকেশী সিংহটা এখন কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের উপর নজর রাখছে।”
এই গুঞ্জনের পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক নজির: ২০১৯ সালে জনসন যখন দায়িত্ব নেন, তখন কনজারভেটিভ পার্টির জনসমর্থন ছিল তলানিতে। কিন্তু মাত্র ছয় মাসে দলটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে। এবার আবার সেই ‘জাদু’ ফেরানোর প্রত্যাশা অনেকের।
আবার কেন জনসন?
বরিস জনসনের প্রশাসনের মেয়াদে ছিল অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি এবং আইন-কানুনের প্রতি অবজ্ঞা। এসব কারণে ২০২২ সালে তিনি তীব্রভাবে অজনপ্রিয় হয়ে পদত্যাগ করেন। তবে তাতেও তার রাজনৈতিক ক্যারিশমা শেষ হয়ে যায়নি।
কনজারভেটিভ পার্টি সম্প্রতি স্থানীয় নির্বাচনে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। এমন সময়ে এক জরিপে দেখা যায়, সম্ভাব্য নেতৃত্বপ্রার্থীদের মধ্যে জনসনই একমাত্র যিনি নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকে পার্টির চেয়েও বেশি সমর্থন পান।
এটা বিজয় নিশ্চয়তা দেয় না ঠিকই, কিন্তু পার্টির সামনে যখন নির্বাচনে হারের শঙ্কা, তখন একটি ‘হাং পার্লামেন্ট’-ও তাদের কাছে বড় পাওয়া।
জনসনকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
জনগণের স্মৃতি ও সস্তা নস্টালজিয়া:
এক ডনকাস্টারের ভোটার ফোকাস গ্রুপে বলেন, “বরিস ছিল নির্বোধ, কিন্তু সে যা ভাবতো, তাই বলতো।”
লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের হাসি:
ব্রেক্সিট এবং জনসনের প্রশাসনিক ব্যর্থতাই দক্ষিণ ইংল্যান্ডে তাদের ভোট বাড়িয়েছে। একজন লিবারেল এমপি তো জনসনকে এক নৈশভোজে গিয়ে বলেন, “আপনার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ!”
লেবার পার্টির তৃপ্তি:
তারা ভোটারদের মনে করিয়ে দিতে চায়, জনসনের সময়টা ছিল বিশৃঙ্খল। বর্তমান পরিস্থিতি যত খারাপই হোক না কেন, সেটি সেই সময়ের তুলনায় ভালো।
রিফর্ম পার্টির সমালোচনা:
জনসনের আমলে এক বছরে ১৩ লাখ অভিবাসী প্রবেশ করেছে। অনেকে একে ‘বরিসওয়েভ’ বলেই উল্লেখ করছেন।
এক দুঃখজনক নাটকের অপূর্ণ সমাপ্তি
জনসনের বিরুদ্ধে লকডাউনে নিয়ম ভাঙার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২০২৩ সালে পার্লামেন্ট তাকে ৯০ দিনের জন্য বরখাস্ত করে। এতে তার আসনে উপনির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু মুখোমুখি না হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।
জনগণ যেন প্রতিশোধ নিতে পারল না—বরিস জনসনকে কেউ গ্রেফতার করল না, কেউ ভোটে হারাল না। ফলে ব্রিটেনের রাজনীতি এক অপূর্ণ প্রতিশোধের ভারে আটকে আছে।
কেন এখনো ফিরে আসা সম্ভব?
জনসনের সময়ের উচ্চ কর এবং অভিবাসন পরিস্থিতির জন্য রিশি সুনাককে দায়ী করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, যখন কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী (কেমি ব্যাডেনোক) বা এক অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি (রিশি সুনাক) থাকেন, তখনই ডানপন্থী ভোটারদের এক অংশ রিফর্ম পার্টির দিকে ঝোঁকে। বিষয়টি জাতিগত বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়, যদিও এর পেছনে কার্যকারণ খোঁজা জটিল।
জনগণের ‘পাপবলে‘ পরিণত বরিস
ফরাসি দার্শনিক রেনে জিরার্ড বলেছিলেন, সমাজ নিজেকে শান্ত রাখতে কাউকে ‘পাপবলে’ বানায়। একসময় যাকে পূজো করা হতো, তাকেই পরে বলি দেওয়া হয়।
জনসনের ক্ষেত্রে সেই বলি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি হঠাৎ রাজনীতি ছাড়লেন, কিন্তু জনতার রোষানলে পড়েননি। ফলে ব্রিটেন তাকে আবার ডাকতে পারে—হয়তো দ্বিতীয়বার সত্যিই তাকে ধ্বংস করবে, অথবা আবার উত্থান ঘটাবে।
জনসন জনপ্রিয় না, দক্ষও না। তবু তার ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। হয়তো তা হবে ব্রিটেনের এক রাজনৈতিক নির্ঘাত ক্যাথারসিস—যেখানে পুরোনো ছায়া মুছে নতুন সূচনা হবে।
“ফিরে আসুন, মি. জনসন। এবার হয় আপনাকে আবার স্বাগত জানাবে ব্রিটেন, নয়তো ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ করবে।”