এক সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার নেওয়া সিদ্ধান্ত ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ শুধু ফিলিস্তিনের সঙ্গে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক বদলে দিতে পারে। তিনি দুইটি পথের একটিতে হাঁটতে পারেন—একটি হলো হামাসকে নির্মূল করতে গাজায় পূর্ণ সামরিক অভিযান চালানো, অন্যটি হলো যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তির পথে ফেরা।
গাজায় পূর্ণ অভিযানের প্রস্তুতি
নেতানিয়াহু ১৯ মে ঘোষণা দেন যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পুরো গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে। তার ডানপন্থী মন্ত্রিসভার সদস্য বেজালেল স্মোটরিচ বলেন, গাজা এখন ‘একটি সন্ত্রাসের শহর’, তাই যা কিছু বাকি আছে তা ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইসরায়েল খান ইউনিস শহরের বাসিন্দাদের সরে যেতে বলেছে, যেখানে একটি ‘অভূতপূর্ব হামলা’র পরিকল্পনা চলছে। ১৩ মে‘র এক বিমান হামলায় হামাসের শীর্ষ কমান্ডার মুহাম্মাদ সিনওয়ার নিহত হয়ে থাকতে পারেন।
১৮ মার্চের যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর থেকে প্রায় ৫,০০০ গাজাবাসী নিহত হয়েছেন, এবং মোট প্রাণহানির সংখ্যা ৫০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। সেনাবাহিনী প্রতিদিন শতাধিক বিমান হামলা চালাচ্ছে। খাদ্যের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত বার্তা: সমর্থন নাকি বিরত থাকা?
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না, তবে নেতানিয়াহুর প্রতি সমর্থনও দিচ্ছে না। মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন। মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইসরায়েল সফর বাতিল করেছেন, যাতে সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত না যায়।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি যুদ্ধ বন্ধ, জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজায় খাদ্য সরবরাহ চান। তবে এ নিয়ে দায় চাপিয়েছেন হামাসের ওপর। তবুও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার দূরত্ব আরও বাড়তে পারে যদি গাজায় পুনরায় স্থল অভিযান শুরু হয়।
গালফ ও ইরান নীতিতে ট্রাম্পের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
নেতানিয়াহু বিস্মিত হন যখন ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় যায় এবং ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা বন্ধ করে। এছাড়া ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েও আগাচ্ছেন, যা গাজার যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সম্ভব নয়। এদিকে ট্রাম্প সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে দেখা করে সে দেশের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন, যা ইসরায়েল মানতে চায়নি।
শান্তির সম্ভাবনা কি একেবারে শেষ?
ইসরায়েলের এক জেনারেল বলেন, অভিযান এমনভাবে সাজানো যে যুদ্ধবিরতি হলে সহজেই থামানো যাবে। দোহায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতার হামাস ও ইসরায়েলকে আলোচনায় বসার জন্য চাপ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে হামাস একজন মার্কিন-ইসরায়েলি সেনাকে মুক্তি দিয়েছে, এবং ইসরায়েল কিছু ত্রাণ সরবরাহে অনুমতি দিয়েছে।
মুহাম্মাদ সিনওয়ারের মৃত্যুতে হামাসের কট্টরপন্থীদের প্রভাব কমে যেতে পারে, ফলে গাজার বাইরের বাস্তববাদী নেতৃত্ব আলোচনার দিকে যেতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। ইসরায়েল চায় একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি, কিন্তু হামাস চায় স্থায়ী যুদ্ধের সমাপ্তি এবং ইসরায়েলের দাবি মেনে নিরস্ত্রীকরণ বা গাজা থেকে নেতা প্রবাসে পাঠানো মানতে নারাজ।
বহির্বিশ্বের চাপ এবং ভেতরের অসন্তোষ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে চায়। ব্রিটেন নতুন চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে। অধিকাংশ ইসরায়েলি যুদ্ধ শেষ করার পক্ষে। বিরোধী নেতা ইয়ায়ার গোলান বলেন, “একটি সুস্থ রাষ্ট্র শিশু হত্যা ও সাধারণ মানুষের উচ্ছেদ করে না।”
গাজার মানুষও চরম কষ্টে। এক জরিপে অর্ধেক বাসিন্দা সুযোগ পেলে গাজা ছেড়ে চলে যেতে চায়।
সমাপ্তি না হলে অন্ধকার ভবিষ্যৎ
যদি শেষ মুহূর্তে কোনো সমঝোতা না হয়, তবে সামনে একটি ধ্বংসাত্মক পরিণতির আশঙ্কা প্রবল। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ছাড়া যুদ্ধ শেষ করবেন না। তবে গাজার সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের আরও বিচ্ছিন্নতা এখন অনেক বেশি সম্ভাব্য বাস্তবতা।
যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে এখনো একটি বাস্তবসম্মত যুদ্ধবিরতির পথ রয়ে গেছে। কিন্তু তা নিতে হলে নেতানিয়াহু বা হামাস—উভয় পক্ষকেই কিছু ছাড় দিতে হবে। তা না হলে, মানবিক বিপর্যয়ের গভীরতা আর কূটনৈতিক একঘরে হয়ে পড়া, ইসরায়েলের ভবিষ্যতের ছায়া হয়ে থাকবে।