নতুন প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা
২০২৪ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্লদিয়া শেইনবাউম মাদক ও সহিংস গ্যাং দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেন। মেক্সিকো সিটির মেয়র থাকাকালে সহিংসতা কমাতে তিনি যে তথ্যভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাফল্য দেখিয়েছিলেন, এখন তা জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োগ করছেন।
দেশজুড়ে গ্যাংবিরোধী এই অভিযান মেক্সিকানদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেলেও এর পেছনে রয়েছে আরেকটি বড় উদ্দেশ্য—যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ম্যাগা রিপাবলিকানদের সন্তুষ্ট করা।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ: সন্ত্রাসী ঘোষণা ও বাণিজ্য অবরোধ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মেক্সিকান গ্যাংগুলোকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ফেব্রুয়ারিতে মেক্সিকোর রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তার ধারণা, মেক্সিকান কর্মকর্তারা গ্যাংদের সঙ্গে আঁতাত করছেন—যার জেরে কিছু মেক্সিকান কর্মকর্তার মার্কিন ভিসা বাতিলও হয়েছে।
বিশেষ বাহিনী দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে অভিযান চালানো এবং মাদক ল্যাব লক্ষ্য করে ড্রোন হামলার কথা বিবেচনা করছে ওয়াশিংটন, যা মেক্সিকোতে শেইনবাউমের নেতৃত্বকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে।
‘আলিঙ্গন নয়, গুলি‘ নীতি: নতুন কৌশল
পূর্বসূরি লোপেজ ওব্রাদরের ‘আলিঙ্গন, গুলি নয়’ নীতির পরিবর্তে শেইনবাউম নিরাপত্তা খাতের ভেতরভাগে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। তিনি গোয়েন্দা তথ্য ও বিভিন্ন নিরাপত্তা শাখার সমন্বয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার নিরাপত্তা সচিব ওমর গার্সিয়া হারফুচ একটি নতুন তদন্তকারী পুলিশ ইউনিট গড়ে তুলছেন, যাদের সঙ্গে থাকবে বিশেষ বাহিনীও। সব মিলিয়ে এই বাহিনীতে প্রায় ১৫,০০০ সদস্য থাকবেন বলে ধারণা।
অভিযানের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা
অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০,০০০ গুরুতর অপরাধের জন্য গ্রেফতার, ১৫৪ টন অবৈধ মাদক উদ্ধার এবং ১০,০০০ এর বেশি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। চোরাই জ্বালানি উদ্ধারেও অগ্রগতি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সীমান্তে সমন্বয় বাড়ানো হয়েছে এবং অবৈধ অভিবাসী ও ফেন্টানিল মাদক পাচারের হার কমেছে। তবে তিজুয়ানার মতো সীমান্ত এলাকায় প্রতিদিন স্থানীয়, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সমন্বিত অভিযানের পরও অপরাধ পুরোপুরি কমেনি। মেক্সিকো সিটিতেই ২০ মে দুজন সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অর্থনীতির চাপ ও নিরাপত্তা বাজেট সংকট
শেইনবাউমের নিরাপত্তা বাজেট জিডিপির অনুপাতে ওইসিডির সবচেয়ে কম। তার শাসনামলে এই বাজেট আরও ৩৬% কমানো হয়েছে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে দেশের অর্থনীতিও চাপের মুখে। এই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সামাজিক কাঠামোর ভাঙন ও গ্যাংদের আধিপত্য
মেক্সিকোর গ্যাংগুলো শুধু মাদক বা অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করে না; তারা অ্যাভোকাডো চাষ, মাছ ধরা, এমনকি টর্টিয়া বিক্রির মতো বৈধ ব্যবসায়ও শেয়ার দাবি করে। এইভাবে বৈধ ও অবৈধ অর্থনীতির মিশ্রণে দেশজুড়ে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। যদিও শেইনবাউম এখনো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেননি, ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্যাংদের আঁতাত স্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি: হস্তক্ষেপ নাকি হামলা?
ম্যাগা সমর্থকদের অনেকে এখন খোলাখুলিভাবে মেক্সিকোয় সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছে। সীমান্তে তিনগুণ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এবং চালানো হচ্ছে নজরদারি ড্রোন ও সাঁজোয়া যান।
শেইনবাউম ইতিমধ্যে ট্রাম্পের সামরিক সহায়তা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, যার জবাবে ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, “ওই নারী গ্যাংদের এতটাই ভয় পায় যে ঠান্ডা মাথায় চিন্তাও করতে পারে না।”
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কি সম্ভব?
মেক্সিকোর গ্যাং দমন কেবল একটি নিরাপত্তা অভিযান নয়—এটি দেশের সমাজ কাঠামোরও পুনর্গঠন দাবি করে। জাতীয় সিটিজেন অবজারভেটরির ফ্রান্সিসকো রিভাস বলেন, গ্যাংদের অর্থায়নের নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলার দিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এই উদ্যোগ সফল করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সাহস, প্রশাসনিক দক্ষতা ও যথেষ্ট বাজেট।
শেষ কথা
শেইনবাউমের পরিকল্পনা হয়তো ট্রাম্পের ড্রোনকে রুখে দেবে, কিন্তু মেক্সিকোর গ্যাং সংস্কৃতিকে চিরতরে নির্মূল করা হবে আরও কঠিন কাজ।