পরিবারের মূল্যবোধ রক্ষার নামে নতুন লড়াই
এই মাসে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্যান-আফ্রিকান কনফারেন্স অন ফ্যামিলি ভ্যালুজ‘। এতে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এবং কিছু পশ্চিমা অতিথি অংশ নেন। সম্মেলনের মূল বার্তা ছিল—আফ্রিকার পরিবার ব্যবস্থা আজ হুমকির মুখে। বক্তারা বলছেন, “বিদেশি মতাদর্শ” আফ্রিকায় গর্ভপাত, সমকামিতা এবং “লিঙ্গ বিভ্রান্তি”র মতো সামাজিক সংকট তৈরি করছে। কেউ কেউ এমনকি যৌনশিক্ষাকেও ইনসেস্টের কারণ বলে উল্লেখ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও ট্রাম্পের ভূমিকা
আফ্রিকার রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠী নিজেদেরকে ঈশ্বরভক্ত এবং পশ্চিমা উদারপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামী হিসেবে তুলে ধরছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমেরিকার ডানপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে তারা এখন অনেক বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন তাদেরকে আরও জোরালো করেছে। একইসঙ্গে, ইউএসএইড (USAID)-এর কার্যক্রম সংকুচিত হওয়ায় উদারপন্থীদের অর্জিত অনেক অধিকার আবার ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
উদারতা বিরোধী আইন ও পশ্চিমা সহায়তা
পরিবারের মূল্যবোধ নিয়ে আরও কিছু সম্মেলন আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে আমেরিকার রক্ষণশীল খ্রিষ্টান সংগঠন, যেমন Family Watch International (FWI) এবং Alliance Defending Freedom (ADF)। এই সংগঠনগুলো রো বনাম ওয়েড মামলায় আমেরিকায় গর্ভপাতের অধিকার বাতিল করতেও ভূমিকা রেখেছিল। এখন তারা আফ্রিকায় যৌনতা ও লিঙ্গ নিয়ে আরও কঠোর আইন প্রণয়নে চাপ দিচ্ছে। ২০২৩ সালে উগান্ডা বিশ্বের অন্যতম কঠোর সমকামবিরোধী আইন পাস করে, যেখানে কিছু সমকাম কার্যকলাপের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। কেনিয়া, ঘানা, নাইজেরিয়ায় একই ধরনের বিল বিবেচনায় রয়েছে।
ধর্মীয় ঐক্য গড়ে উঠছে
এই রক্ষণশীল আন্দোলন নতুন নয়, তবে দুটি কারণ একে শক্তিশালী করে তুলেছে—২০০০ দশকের শুরুতে এইডস সংকট আমেরিকান ইভানজেলিকদের আফ্রিকায় নিয়ে আসে এবং বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সি তাদের মধ্যে একধরনের ‘ধর্মীয় ক্ষয়িষ্ণুতা‘র ভয় সৃষ্টি করে। ফলে আফ্রিকাকে তারা ‘বাইবেলিক মূল্যবোধের শেষ দুর্গ‘ হিসেবে দেখতে শুরু করে।
বিদেশি অর্থায়ন ও স্থানীয় আইন প্রভাবিত হচ্ছে
Institute for Journalism and Social Change-এর তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত অন্তত ১৭টি আমেরিকান খ্রিষ্টান সংগঠন আফ্রিকায় ১৬.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে কারণ অধিকাংশ আমেরিকান চার্চ তাদের বিদেশি ব্যয়ের হিসাব দেয় না।
অবস্থান পরিবর্তন ও কৌশলের আধুনিকায়ন
আগে যেসব সংগঠন গর্ভপাত বা সমকামিতার বিরুদ্ধে ‘শয়তানি‘ ভাষায় কথা বলত, এখন তারা ‘মানবাধিকারের ভাষা‘ ব্যবহার করছে। নাইরোবির সম্মেলনে বক্তারা বলছেন, “পিতামাতার অধিকার রয়েছে তাদের সন্তানদের যৌন শিক্ষার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার।”
FWI-এর প্রধান শ্যারন স্লেটার আফ্রিকান রাজনীতিকদের জাতিসংঘে প্রভাব বিস্তারে প্রশিক্ষণ দেন। ADF আফ্রিকান ইউনিয়নের মানবাধিকার কমিশনে পর্যবেক্ষক হওয়ার আবেদন করেছে। FWI ইতিমধ্যেই ইথিওপিয়ার রাজধানীতে কার্যক্রম শুরু করেছে।
ক্ষমতার শীর্ষে রক্ষণশীলদের আধিপত্য
আফ্রিকার শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা যেমন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো এবং ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ জন্মসূত্রে খ্রিষ্টান। তাদের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেও রক্ষণশীল মনোভাব প্রচলিত। উগান্ডার ফার্স্ট লেডি জ্যানেট মুসেভেনির মতো অনেকে সরাসরি রক্ষণশীল নীতিকে সমর্থন করেছেন।
জনমত ও রাজনৈতিক সুবিধা
অ্যাফ্রোবারোমিটার অনুযায়ী, আফ্রিকায় সমকামিতা ও গর্ভপাত ব্যাপকভাবে অগ্রহণযোগ্য। অনেক সময় দুর্বল জনপ্রিয়তাসম্পন্ন সরকার এই ইস্যুগুলোকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। রুটো তার শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে গত বছর সমকামী অধিকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মত দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতির প্রভাব ও ইউএসএইড বন্ধ
বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন আফ্রিকায় রক্ষণশীল নীতিকে উৎসাহিত করছে। আগে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে উদারপন্থী অবস্থান নেওয়া হতো, এখন তা বদলে যাচ্ছে। ইউএসএইড বন্ধ হওয়ায় খ্রিষ্টান এনজিওগুলো আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স মন্তব্য করেছেন, “আমেরিকা করদাতার অর্থ ব্যবহার করে কীভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে এমন এনজিওকে অর্থ দেয়?”
ভবিষ্যতের সংকেত
Ipas-এর গিলিয়ান কেইন বলছেন, এমনকি ‘নারী অঙ্গচ্ছেদের মতো বিষয়, যা সবাই অগ্রহণযোগ্য মনে করে‘, সেগুলো নিয়েও আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। আফ্রিকায় ইভানজেলিক খ্রিষ্টধর্মের উত্থান, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, ভবিষ্যতের সামাজিক রক্ষণশীলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগে রক্ষণশীলরা ছিল আতঙ্কিত—এখন আতঙ্কে আছে উদারপন্থীরা।
শেষ কথা
আফ্রিকার খ্রিষ্টান রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা ধর্মীয় শক্তির এই মিলন সমাজে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বৈশ্বিক কৌশল এবং সাধারণ জনগণের মূল্যবোধের ওপর।