১১:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

আমাজনের আগুনে পুড়ল সবুজ প্রতিশ্রুতি

বনের জায়গায় এখন আগুনে ঢাকা আকাশ

২০২৪ সালে লাতিন আমেরিকার প্রাচীন ট্রপিকাল বনভূমির ৫১,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়েছে, যার ৬০ শতাংশই আগুনের কারণে—এটি একটি রেকর্ড। আগের বছরের তুলনায় এই ধ্বংস ১৪২ শতাংশ বেশি, ফলে ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার বন রক্ষার যাবতীয় অগ্রগতি কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এই ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’ (GFW), যা ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি স্যাটেলাইটভিত্তিক বন পর্যবেক্ষণ সংস্থা। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সাল ছিল ইতিহাসের অন্যতম উষ্ণতম বছর, যার সঙ্গে এল নিনো জলবায়ু প্রভাব মিলিত হয়ে পুরো আমাজন অববাহিকাকে ‘আগুনের বাক্সে’ পরিণত করেছে।

খামারিদের আগুনে নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার

সয়া চাষ বা গবাদিপশু চরানোর জন্য কৃষকেরা আগুন লাগালেও তা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। GFW বলছে, এই আগুনের কারণে ১.১৫ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়েছে, যা ২০২৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে সৃষ্ট কার্বনের চেয়েও বেশি।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাজিল

আমাজনের অধিকাংশ অংশ থাকা ব্রাজিল সবচেয়ে বেশি বন হারিয়েছে—প্রায় ২৮,২০০ বর্গকিলোমিটার। ২০১৬ সালের পর এটিই সর্বোচ্চ। দেশটির তথাকথিত ‘পরিবেশবাদী’ প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সবুজ ভাবমূর্তি এই বিপর্যয়ে আঘাত পেয়েছে। যদিও ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বন উজাড় ৩৩ শতাংশ কমে এসেছিল, ২০২৪ সালের দাবদাহ এবং ভয়াবহ খরা সেই অর্জন মুছে দিয়েছে। ব্রাজিলে গত বছর হওয়া আগুনে আমাজনের ৬০ শতাংশ ধ্বংস হয়।

অর্থনীতির নামে উজাড় নীতি

ব্রাজিলের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো কৃষিখাতে উন্নয়নের অজুহাতে বন রক্ষার আইন শিথিল করছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে মাতো গ্রোসো রাজ্যের আইনপ্রণেতারা বন সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোম্পানির ট্যাক্স ছাড় বাতিল করে। রোন্ডোনিয়া রাজ্যে পাস হয় ‘অ্যামনেস্টি আইন’, যা পূর্বের বন উজাড়কে ক্ষমা করে দেয়। এই সিদ্ধান্তগুলো মূলত ভূমি দখল ও অগ্নিসংযোগকে উৎসাহিত করছে।

বলিভিয়ায় বিস্ফোরক বন ধ্বংস

ব্রাজিলের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে থাকা বলিভিয়ায় সরকার বহু বছর ধরেই ঋণ সুবিধা ও কর ছাড় দিয়ে বন কেটে চাষাবাদে মানুষকে উৎসাহিত করছে। ২০১৯ সালে তারা গরুর মাংস রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং চাষের জন্য আগুন লাগানোকে বৈধতা দেয়। এর ফলে বন উজাড় পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বলিভিয়ার ৫৭ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে গবাদিপশু পালনের জন্য। ২০২৪ সালে দেশটি ১৪,৮০০ বর্গকিলোমিটার বন হারিয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২০০ শতাংশ বেশি। মাত্র ৬টি মামলায় শাস্তি হয়েছে।

পেরু ও কলম্বিয়াতেও বিপর্যয়

পেরুর সরকার ২০২৪ সালে বন আইন পরিবর্তন করে অবৈধ বন উজাড়কারীদের কার্যত ক্ষমা করে দিয়েছে। এতে সে বছর দেশটির বন ধ্বংস ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। অপরদিকে, কলম্বিয়ায় সোনার উচ্চমূল্য এবং কোকা (মাদক দ্রব্যে ব্যবহৃত উদ্ভিদ) চাষ বাড়াতে বন উজাড়ে জড়িয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। প্রাথমিক বনভূমি ধ্বংস বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। নিরাপত্তাহীনতাই এর মূল কারণ।

গায়ানার বনও আর নিরাপদ নয়

কার্বন সমৃদ্ধ এবং জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ বন রক্ষায় অর্থ চাইছে গায়ানা। কিন্তু সেখানে ২০২৪ সালে বন উজাড় বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ—মূলত আগুন এবং অবৈধ স্বর্ণ খননের কারণে। যদিও এটি তুলনামূলকভাবে স্বল্প মাত্রার ভিত্তি থেকে এসেছে, তবুও এটি স্পষ্ট করছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে ভালো উদ্দেশ্যও পরাজিত হতে পারে।

উপসংহার

আমাজনের আগুন শুধু বন নয়, ধ্বংস করছে দক্ষিণ আমেরিকার পরিবেশগত অগ্রগতিকে। যতদিন না জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে কার্যকর এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ততদিন এসব অঞ্চল আগুনেই পুড়তে থাকবে।

আমাজনের আগুনে পুড়ল সবুজ প্রতিশ্রুতি

০৫:৫৬:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

বনের জায়গায় এখন আগুনে ঢাকা আকাশ

২০২৪ সালে লাতিন আমেরিকার প্রাচীন ট্রপিকাল বনভূমির ৫১,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়েছে, যার ৬০ শতাংশই আগুনের কারণে—এটি একটি রেকর্ড। আগের বছরের তুলনায় এই ধ্বংস ১৪২ শতাংশ বেশি, ফলে ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার বন রক্ষার যাবতীয় অগ্রগতি কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এই ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’ (GFW), যা ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি স্যাটেলাইটভিত্তিক বন পর্যবেক্ষণ সংস্থা। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সাল ছিল ইতিহাসের অন্যতম উষ্ণতম বছর, যার সঙ্গে এল নিনো জলবায়ু প্রভাব মিলিত হয়ে পুরো আমাজন অববাহিকাকে ‘আগুনের বাক্সে’ পরিণত করেছে।

খামারিদের আগুনে নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার

সয়া চাষ বা গবাদিপশু চরানোর জন্য কৃষকেরা আগুন লাগালেও তা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। GFW বলছে, এই আগুনের কারণে ১.১৫ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়েছে, যা ২০২৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে সৃষ্ট কার্বনের চেয়েও বেশি।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাজিল

আমাজনের অধিকাংশ অংশ থাকা ব্রাজিল সবচেয়ে বেশি বন হারিয়েছে—প্রায় ২৮,২০০ বর্গকিলোমিটার। ২০১৬ সালের পর এটিই সর্বোচ্চ। দেশটির তথাকথিত ‘পরিবেশবাদী’ প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সবুজ ভাবমূর্তি এই বিপর্যয়ে আঘাত পেয়েছে। যদিও ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বন উজাড় ৩৩ শতাংশ কমে এসেছিল, ২০২৪ সালের দাবদাহ এবং ভয়াবহ খরা সেই অর্জন মুছে দিয়েছে। ব্রাজিলে গত বছর হওয়া আগুনে আমাজনের ৬০ শতাংশ ধ্বংস হয়।

অর্থনীতির নামে উজাড় নীতি

ব্রাজিলের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো কৃষিখাতে উন্নয়নের অজুহাতে বন রক্ষার আইন শিথিল করছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে মাতো গ্রোসো রাজ্যের আইনপ্রণেতারা বন সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোম্পানির ট্যাক্স ছাড় বাতিল করে। রোন্ডোনিয়া রাজ্যে পাস হয় ‘অ্যামনেস্টি আইন’, যা পূর্বের বন উজাড়কে ক্ষমা করে দেয়। এই সিদ্ধান্তগুলো মূলত ভূমি দখল ও অগ্নিসংযোগকে উৎসাহিত করছে।

বলিভিয়ায় বিস্ফোরক বন ধ্বংস

ব্রাজিলের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে থাকা বলিভিয়ায় সরকার বহু বছর ধরেই ঋণ সুবিধা ও কর ছাড় দিয়ে বন কেটে চাষাবাদে মানুষকে উৎসাহিত করছে। ২০১৯ সালে তারা গরুর মাংস রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং চাষের জন্য আগুন লাগানোকে বৈধতা দেয়। এর ফলে বন উজাড় পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বলিভিয়ার ৫৭ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে গবাদিপশু পালনের জন্য। ২০২৪ সালে দেশটি ১৪,৮০০ বর্গকিলোমিটার বন হারিয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২০০ শতাংশ বেশি। মাত্র ৬টি মামলায় শাস্তি হয়েছে।

পেরু ও কলম্বিয়াতেও বিপর্যয়

পেরুর সরকার ২০২৪ সালে বন আইন পরিবর্তন করে অবৈধ বন উজাড়কারীদের কার্যত ক্ষমা করে দিয়েছে। এতে সে বছর দেশটির বন ধ্বংস ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। অপরদিকে, কলম্বিয়ায় সোনার উচ্চমূল্য এবং কোকা (মাদক দ্রব্যে ব্যবহৃত উদ্ভিদ) চাষ বাড়াতে বন উজাড়ে জড়িয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। প্রাথমিক বনভূমি ধ্বংস বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। নিরাপত্তাহীনতাই এর মূল কারণ।

গায়ানার বনও আর নিরাপদ নয়

কার্বন সমৃদ্ধ এবং জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ বন রক্ষায় অর্থ চাইছে গায়ানা। কিন্তু সেখানে ২০২৪ সালে বন উজাড় বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ—মূলত আগুন এবং অবৈধ স্বর্ণ খননের কারণে। যদিও এটি তুলনামূলকভাবে স্বল্প মাত্রার ভিত্তি থেকে এসেছে, তবুও এটি স্পষ্ট করছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে ভালো উদ্দেশ্যও পরাজিত হতে পারে।

উপসংহার

আমাজনের আগুন শুধু বন নয়, ধ্বংস করছে দক্ষিণ আমেরিকার পরিবেশগত অগ্রগতিকে। যতদিন না জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে কার্যকর এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ততদিন এসব অঞ্চল আগুনেই পুড়তে থাকবে।