১২:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

ইন্দাসের পানি নিয়ে মিমাংসার জন্যে পাকিস্তানকে আগে ভারতকে জানাতে হবে

এ মাসের শুরুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা সামরিক সংঘর্ষের পরে, ১০ মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও ২৩ এপ্রিল ভারত একতরফাভাবে ‘ইন্দাস পানি চুক্তি’ স্থগিত করায় দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন বিষয়ক আলোচনা এখনো ঝুলে রয়েছে। উল্লেখ্য, চুক্তি স্থগিতের একদিন আগে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একটি প্রাণঘাতী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।

এর জবাবে পাকিস্তান সরকার জানায়, “ইন্দাস পানি চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রাপ্য পানির প্রবাহ থামানোর বা সরিয়ে দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টা এবং নিম্ন অববাহিকার অধিকার হরণকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে।” কিন্তু ভারতের তরফ থেকে এ সিদ্ধান্ত এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি, যা পাকিস্তানের কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে—যেখানে ৮০ শতাংশ চাষাবাদ ও জলবিদ্যুৎ নির্ভর করে ইন্দাস পানির ওপর।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শফকত আলী খান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “পাকিস্তান তার ন্যায্য পানির হিস্যা রক্ষার জন্য সব ধরনের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে।” তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।

পাকিস্তান কী করতে পারে যাতে পানি প্রবাহ বজায় থাকে এবং কৃষি ও বিদ্যুৎ সুরক্ষিত থাকে? চারটি সম্ভাব্য পথ নিচে তুলে ধরা হলো—

বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতা

ভারত ও পাকিস্তান ১৯৬০ সালে পানি বণ্টন চুক্তি করেছিল, যা বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত হয়। এখন পাকিস্তান আশা করছে বিশ্বব্যাংক আবারও মধ্যস্থতা করবে। যদিও চলতি মাসের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা জানান, বিশ্বব্যাংক বিরোধ মীমাংসায় মধ্যস্থতা করবে না, তবে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তির ধারা অনুযায়ী প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করতে পারে।

এ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের একাধিক বিভাগ একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বিশ্বব্যাংকে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সরকারের এক কর্মকর্তা।

ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ’-এর চেয়ারম্যান খালিদ রহমান বলেন, “আন্তর্জাতিক আইনে উচ্চ ও নিম্ন অববাহিকার রাষ্ট্রগুলোর অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্ট। ভারত স্পষ্টত এই নিয়ম লঙ্ঘন করছে এবং পাকিস্তানের আইনি ভিত্তি আছে এর জবাব দেওয়ার।”

আন্তর্জাতিক ফোরামে মামলা

যদি বিশ্বব্যাংক সহায়তা না করে, তবে পাকিস্তান অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা নাসির মেমন বলেন, “চুক্তির ধারা অনুযায়ী পাকিস্তান হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।”

তবে অন্য অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া অনেক ধীর এবং তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়।

আমেরিকার টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এরুম সত্তার বলেন, “আন্তর্জাতিক আইন ও আনুষ্ঠানিক রায় পাওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ এবং এর তাৎক্ষণিক কার্যকারিতা দুর্বল।”

ভারতের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাইলে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করতে পারে, যদি দিল্লি সম্মত হয়।

আইপিএস চেয়ারম্যান রহমান বলেন, “যুদ্ধবিরতি হলেও ভারতের মনে সংঘাতের মানসিকতা এখনো থাকতে পারে, তবে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”

তবে তিনি সতর্ক করেন, “যদি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়, তাহলে তা আলোচনাকে জটিল করে তুলতে পারে।”

এরুম সত্তার বলেন, পাকিস্তানকে প্রথমে ভারতের কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে যে, চুক্তির কাঠামোর মধ্যে থেকে যে কোনো সংশোধন নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত তারা।

তিনি আরও বলেন, “চুক্তির বাইরের একতরফা স্থগিতকরণ আইনগতভাবে বৈধ নয় এবং এটা নীতিগতভাবে ভুল—এটা আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সব পর্যায়ে পাকিস্তানকে তুলে ধরতে হবে।”

কূটনৈতিক প্রচারণা চালানো

পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল পাঠাবে যাতে এই জলবণ্টন ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক সমর্থন চাওয়া যায়। এর অংশ হিসেবে ভারতও গত সপ্তাহে তার নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছে।

এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তান সরকারের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টিও আলোচনায় আসবে।

করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনিস আহমার বলেন, কূটনৈতিক প্রচারণায় সাফল্য পেতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই অত্যন্ত পেশাদারভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে।

তিনি বলেন, “পূর্বে পাকিস্তান তার মামলাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি, তাই তা গুরুত্ব পায়নি।” তিনি আরও বলেন, “পেশাদারিত্ব, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, আইনি বিশ্লেষণ ও দক্ষতা দিয়ে পানি চুক্তি বিষয়ক প্রস্তাব তৈরি করাই হবে এই কূটনৈতিক উদ্যোগের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।”

লেখক: আদনান আমির
(অনুবাদ ও সংক্ষেপ: সারাক্ষণ এর রিপোর্টিং বিভাগের)

ইন্দাসের পানি নিয়ে মিমাংসার জন্যে পাকিস্তানকে আগে ভারতকে জানাতে হবে

০৩:১৪:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

এ মাসের শুরুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা সামরিক সংঘর্ষের পরে, ১০ মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও ২৩ এপ্রিল ভারত একতরফাভাবে ‘ইন্দাস পানি চুক্তি’ স্থগিত করায় দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন বিষয়ক আলোচনা এখনো ঝুলে রয়েছে। উল্লেখ্য, চুক্তি স্থগিতের একদিন আগে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একটি প্রাণঘাতী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।

এর জবাবে পাকিস্তান সরকার জানায়, “ইন্দাস পানি চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রাপ্য পানির প্রবাহ থামানোর বা সরিয়ে দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টা এবং নিম্ন অববাহিকার অধিকার হরণকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে।” কিন্তু ভারতের তরফ থেকে এ সিদ্ধান্ত এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি, যা পাকিস্তানের কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে—যেখানে ৮০ শতাংশ চাষাবাদ ও জলবিদ্যুৎ নির্ভর করে ইন্দাস পানির ওপর।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শফকত আলী খান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “পাকিস্তান তার ন্যায্য পানির হিস্যা রক্ষার জন্য সব ধরনের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে।” তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।

পাকিস্তান কী করতে পারে যাতে পানি প্রবাহ বজায় থাকে এবং কৃষি ও বিদ্যুৎ সুরক্ষিত থাকে? চারটি সম্ভাব্য পথ নিচে তুলে ধরা হলো—

বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতা

ভারত ও পাকিস্তান ১৯৬০ সালে পানি বণ্টন চুক্তি করেছিল, যা বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত হয়। এখন পাকিস্তান আশা করছে বিশ্বব্যাংক আবারও মধ্যস্থতা করবে। যদিও চলতি মাসের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা জানান, বিশ্বব্যাংক বিরোধ মীমাংসায় মধ্যস্থতা করবে না, তবে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তির ধারা অনুযায়ী প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করতে পারে।

এ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের একাধিক বিভাগ একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বিশ্বব্যাংকে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সরকারের এক কর্মকর্তা।

ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ’-এর চেয়ারম্যান খালিদ রহমান বলেন, “আন্তর্জাতিক আইনে উচ্চ ও নিম্ন অববাহিকার রাষ্ট্রগুলোর অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্ট। ভারত স্পষ্টত এই নিয়ম লঙ্ঘন করছে এবং পাকিস্তানের আইনি ভিত্তি আছে এর জবাব দেওয়ার।”

আন্তর্জাতিক ফোরামে মামলা

যদি বিশ্বব্যাংক সহায়তা না করে, তবে পাকিস্তান অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা নাসির মেমন বলেন, “চুক্তির ধারা অনুযায়ী পাকিস্তান হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।”

তবে অন্য অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া অনেক ধীর এবং তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়।

আমেরিকার টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এরুম সত্তার বলেন, “আন্তর্জাতিক আইন ও আনুষ্ঠানিক রায় পাওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ এবং এর তাৎক্ষণিক কার্যকারিতা দুর্বল।”

ভারতের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাইলে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করতে পারে, যদি দিল্লি সম্মত হয়।

আইপিএস চেয়ারম্যান রহমান বলেন, “যুদ্ধবিরতি হলেও ভারতের মনে সংঘাতের মানসিকতা এখনো থাকতে পারে, তবে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”

তবে তিনি সতর্ক করেন, “যদি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়, তাহলে তা আলোচনাকে জটিল করে তুলতে পারে।”

এরুম সত্তার বলেন, পাকিস্তানকে প্রথমে ভারতের কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে যে, চুক্তির কাঠামোর মধ্যে থেকে যে কোনো সংশোধন নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত তারা।

তিনি আরও বলেন, “চুক্তির বাইরের একতরফা স্থগিতকরণ আইনগতভাবে বৈধ নয় এবং এটা নীতিগতভাবে ভুল—এটা আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সব পর্যায়ে পাকিস্তানকে তুলে ধরতে হবে।”

কূটনৈতিক প্রচারণা চালানো

পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল পাঠাবে যাতে এই জলবণ্টন ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক সমর্থন চাওয়া যায়। এর অংশ হিসেবে ভারতও গত সপ্তাহে তার নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছে।

এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তান সরকারের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টিও আলোচনায় আসবে।

করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনিস আহমার বলেন, কূটনৈতিক প্রচারণায় সাফল্য পেতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই অত্যন্ত পেশাদারভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে।

তিনি বলেন, “পূর্বে পাকিস্তান তার মামলাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি, তাই তা গুরুত্ব পায়নি।” তিনি আরও বলেন, “পেশাদারিত্ব, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, আইনি বিশ্লেষণ ও দক্ষতা দিয়ে পানি চুক্তি বিষয়ক প্রস্তাব তৈরি করাই হবে এই কূটনৈতিক উদ্যোগের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।”

লেখক: আদনান আমির
(অনুবাদ ও সংক্ষেপ: সারাক্ষণ এর রিপোর্টিং বিভাগের)