এক সময় গ্রামের প্রান্তে ও উপকূলের চরে ছুটে বেড়াত যেসব হরিণ, আজ তারা বিলুপ্তির পথে। বনভূমি সংকোচন, শিকার ও মানব হস্তক্ষেপে ধ্বংস হচ্ছে একেকটি জীববৈচিত্র্যের প্রতীক।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের এক অনবদ্য উপাদান ছিল হরিণ। শুধু সুন্দরবন নয়, একসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বনভূমি, পাহাড় ও চরাঞ্চলে বিচরণ করত নানা প্রজাতির হরিণ। কিন্তু আজ এই চিত্র বদলে গেছে। যেসব প্রজাতি একসময় গর্বের সঙ্গে আমাদের প্রকৃতিকে রাঙাত, আজ সেসব হয় বিলুপ্ত, নয়তো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এই পতনের পেছনে রয়েছে মানব লোভ, প্রশাসনিক অবহেলা, এবং পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব। এই প্রতিবেদন তুলে ধরছে সেই বিস্মৃত বনভূষণের করুণ বাস্তবতা।
এক সময়ের বনরাজ্যে হরিণের পদচারণা
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কিংবা উপকূলের চরে কোনো এক সময় হরিণের ছুটোছুটি ছিল খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। বনভূমিতে চিত্রল হরিণের চোখ ধাঁধানো দৌড়, কিংবা পাহাড়ি ঝোপে কাঁক হরিণের নির্ভীক উপস্থিতি—সবই ছিল আমাদের জীববৈচিত্র্যের অন্তর্গত। ষাট কিংবা সত্তর বছর আগেও দেশের উপকূল ও বনাঞ্চলে নানা প্রজাতির হরিণের অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা শুধু কমে যায়নি, বরং অনেক জায়গা থেকে চিরতরে হারিয়েও গেছে।
এই হ্রাস শুধুই সংখ্যার নয়—এটি একটি দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য হারানোর গল্প, বনজ সম্পদের প্রতি অবহেলার ইতিহাস।
যারা ছিল, আর যাদের আমরা ভুলে গেছি
বাংলাদেশে একসময় অন্তত পাঁচ প্রজাতির হরিণ পাওয়া যেত। আজ সেসবের অনেকটাই স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
চিত্রল হরিণ—সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতি। দেহজুড়ে সাদা ফোঁটা, সৌন্দর্যে অতুলনীয়। বর্তমানে সুন্দরবনই একমাত্র বড় আবাসস্থল।
বার্কিং ডিয়ার (কাঁক)—ছোট আকৃতির এই হরিণ মূলত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যেত, এখন অনেকটাই কমে গেছে।
হগ ডিয়ার—পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে পাওয়া যেত, এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন।
সাম্বার হরিণ—এক সময়ের রাজবাড়ির বনের গর্ব, এখন কেবল চিড়িয়াখানায় দেখা মেলে।
বারাশিঙ্গা বা জলাভূমির হরিণ—এই হরিণ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে।
নিঝুম দ্বীপের নাটকীয় উত্থান ও পতন
১৯৭০-এর দশকে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে বন বিভাগ মাত্র ১৪টি চিত্রল হরিণ অবমুক্ত করেছিল। এটি তখন ছিল এক বিপ্লবী উদ্যোগ। বনভূমি, খাদ্য প্রাচুর্য এবং শিকার নিষিদ্ধ থাকায় এই হরিণ দ্রুত সংখ্যায় বাড়ে। ১৯৯৬ সাল নাগাদ হরিণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২২,০০০-এ। কিন্তু সেই সময়ের উল্লাস বেশি দিন থাকেনি।
বর্তমানে নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা কমে এসেছে দুই হাজারেরও নিচে। অবৈধ বসতি, কৃষি জমিতে রূপান্তর, খাদ্য সংকট এবং শিকার এই পতনের মূল কারণ।
সুন্দরবনে যা বেঁচে আছে, তা-ও ঝুঁকির মুখে
সুন্দরবন যেন হরিণের শেষ আশ্রয়। ২০০৪ সালে যেখানে চিত্রল হরিণের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৩,০০০, ২০২৩ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১,৩৬,০০০-এ। এই বৃদ্ধির পেছনে বন বিভাগের সংরক্ষণ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
তবে একই সঙ্গে, বার্কিং ডিয়ার বা কাঁক হরিণের পতনও লক্ষ্যণীয়। একসময় যাদের সংখ্যা ছিল দুই হাজারের কাছাকাছি, তা এখন নেমে এসেছে মাত্র ৬৮৭-এ।
সুন্দরবনের চোরাশিকার, বনজীবীদের খাদ্য হিসেবে হরিণের ব্যবহার এবং নদীভাঙনের কারণে এদের বাসস্থান সংকুচিত হয়ে আসছে।
বন্দিত্বে প্রজনন, কিন্তু মুক্তিতে ব্যর্থতা
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে চিত্রল হরিণের সংখ্যা এখন কয়েক হাজার। এখানে তাদের প্রজননে সাফল্য এলেও, প্রকৃতিতে তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা স্পষ্ট।
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবমুক্ত করা এই হরিণেরা নতুন পরিবেশে টিকে থাকতে পারেনি। খাদ্যের অভাব, প্রাকৃতিক শত্রুর অনুপস্থিতি এবং মানবদৃষ্টি থেকে লুকাতে না পারা তাদের দ্রুত ঝুঁকির মুখে ফেলে।
বিশ্বদৃশ্যপট: বাংলাদেশ একা নয়
এই সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়। ফিলিপাইনের ফিলিপাইন ডিয়ার কিংবা ভারতের কাশ্মীরের হ্যাংগুল—সবই আবাসস্থল হারিয়ে এখন বিলুপ্তির পথে। হ্যাংগুল সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘প্রজেক্ট হ্যাংগুল’ নামে এক রাষ্ট্রীয় প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো প্রকল্প এখনো গৃহীত হয়নি।
এইসব উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রকৃতি উপেক্ষিত হলে তার প্রতিশোধও হয় নিষ্ঠুর।
এখনই প্রয়োজন কার্যকর পরিকল্পনা
হরিণদের আর সময় নেই। তাদের রক্ষায় দরকার:
- সংরক্ষিত বনভূমি সম্প্রসারণ।
- চোরাশিকার দমন আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ।
- স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা ও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা।
- নিয়মিত জনসংখ্যা জরিপ ও গবেষণা।
হরিণ হারানো মানে বন হারানো
হরিণ শুধু একটি প্রাণী নয়। তারা একেকটি বনজ সমাজের প্রতিনিধি। তাদের হারিয়ে যাওয়ার অর্থ একটি পরিবেশগত ব্যবস্থার ধ্বংস। আর আমরা যদি এখনই না জাগি, তাহলে একদিন হয়তো আমাদের নাতিপুতিরা শুধু বইয়ের পাতায় পড়বে—বাংলাদেশে একসময় হরিণ ছিল।
হরিণ আমাদের বনভূষণ, আমাদের সংবেদনশীলতার প্রতীক। সেই স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।