লনার নিম্নাঞ্চলের বুকে বর্ণাঢ্য শস্যচাষের একসময় সোনালী অধ্যায় ছিল—ধানক্ষেতের শ্যামল রেখা, কলাবাগানের ঝর্ণাধার, ভুট্টার সোনালি গ্রন্থি আর নানা রঙের শাকসবজির সারি। সেই জমিতে আজকের চিত্র যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার আভাস: লবণজলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়ে উঠছে চিংড়ি পুকুর, আর পুরনো ফসলেরা পরিচ্ছন্নতা হারিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ছায়া ফেলে।
গত দশক জুড়ে হয়ে উঠেছে চিংড়ি বিপ্লব। ঝড়ের গতিতে বেড়েছে চিংড়ি চাষের পুকুর, অর্থনৈতিক উৎসাহকেই প্রধান প্রেরণা হিসেবে নিয়েছে স্থানীয় কৃষক। কিন্তু এই লাভের সঙ্গে পিছনে ফেলে এসেছে ভাত, শাকসবজি ও মৌসুমী ফলের রসালো বৈচিত্র্য—যে ফসলগুলো একসময় বাজার এবং ঘরের খাদ্যতালিকাকে সুষম করে তুলত। ফলস্বরূপ, গৃহস্থ শিশুদের চলছে মৌসুমী ফলাবর্জনার দুঃখ—সেসব আম, লিচু, বিভিন্ন ফল এখন ইতিহাসের পাতায় রূপ নিয়েছে।
এই পাঁচ পর্বের সিরিজে আমরা অনুসন্ধান করবো: কী করে খুলনার কৃষকদের জীবিকা বদলে দিয়েছে চিংড়ির উচ্চমূল্য; হারিয়ে যাওয়া ফসলগুলো ফিরিয়ে আনতে কি কোনো পথ রয়েছে; খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সংকটের মুখে গ্রামের মানুষদের সংগ্রাম; পাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাব, সামুদ্রিক লবণের ছোঁয়া আর সরকারের কৃষি নীতি কতটা ভূমিকা রাখছে এই পরিবর্তনে। থাকছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গল্প এবং বাস্তবতার চিত্র, যার আলোকে আমরা তুলে ধরব চিংড়ি চাষের অজানা দিক এবং সম্ভাব্য সমাধান।
মাটিতে লবণ বেড়ে যাওয়ায় একসময়ের উর্বর জমিতে এখন ধান তো দূরের কথা, কচুও গজায় না। খুলনার কয়রা উপজেলার লবণনেশা গ্রামে ২০১৫ সালে যেখানে ৬৮ শতাংশ বাড়ির নিজস্ব ধান-ভাণ্ডার ছিল, ২০২৫-এ তা নেমে এসেছে মাত্র ১২ শতাংশে। ঘেরের মালিকেরা বড়দিনে নগদ টাকা পেলেও বাকি সময় চাল-ডাল-সবজি সব কিনতে হচ্ছে বাজার থেকে। ফলে গ্রামের পুষ্টিচিত্রও বদলে গেছে—জাতীয় পুষ্টি জরিপ অনুযায়ী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিশুদের অপুষ্টির হার জাতীয় গড়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি।
মহিলা ও শিশুরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। আগে বাগানের কলা-লাউ-কুমড়া থেকে বাড়ির খাবার সরবরাহ হতো; এখন সেসব বাগান ঘেরের পাড় হয়ে গেছে, যেখানে লোনা-বালি ছাড়া কিছুই জন্মে না। রমেছা বেগম বলেন, “মাস গেলে চিংড়ির টাকা হাতে পাই; কিন্তু বাজারে দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শেষমেশ ধার-দেনা বাড়ে।”
এখন অনেকেই বিকল্প খাদ্য মজুত করতে গিয়ে এনজিও-ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণে জড়াচ্ছেন। একদিকে ঝুঁকির ঘের, অন্যদিকে ঋণের কিস্তি—দুই চাপেই অসহায় অনুভব করেন চাষিরা। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, খাদ্য-নিরাপত্তার এমন নড়বড়ে পরিস্থিতিতে যে-কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুলনার সমগ্র গ্রামীণ অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
ধান-চিংড়ি সমন্বিত চাষে প্রতিবছর ৩-৪ মাস খরচ নিয়ন্ত্রণ করে ধান ফলানোর কিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও সার্বিকভাবে তাতে অগ্রগতি ধীর। কারণ, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে অনুমোদিত সুইচ-গেট বা মিঠাজলের উৎস নেই, এবং বছর-বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস গৃহস্থালির সব হিসাব ওলট-পালট করে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধান ও চিংড়ির মাঝামাঝি লবণ-সহিষ্ণু ‘বিরূপা’ জাতের চাল পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে। কয়েকটি ঘেরের পাড়ে সীমিত সাফল্য মিললেও বিস্তারের জন্য প্রয়োজন সেচ-ব্যবস্থায় সমন্বিত উদ্যোগ। পরের পর্বে থাকছে—পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটের গভীর ক্ষত।