১০:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা: বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের জন্য সতর্কবার্তা

অনিশ্চয়তা ও চাপে বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ভয়াবহ চাপে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান শুল্কযুদ্ধ, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলার পুনর্গঠন এবং দেশের অস্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ পরিবেশ মিলে রপ্তানিনির্ভর গার্মেন্টস খাতকে একপ্রকার ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী ভিয়েতনামের সংকট থেকে বাংলাদেশ মূল্যবান শিক্ষা নিতে পারে।

ভিয়েতনামের শিক্ষা: দুই পরাশক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষা

ভিয়েতনাম চীনের কাছ থেকে ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করে এবং রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। অথচ মার্কিন প্রশাসন চায় ভিয়েতনাম যেন চীনের তৈরি পণ্যের উৎপত্তি দেশ গোপন করে রপ্তানি বন্ধ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে এই নিয়ে ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি এসেছে। ফলে এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে চীনের ওপর নির্ভরতা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশকে যদি বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হয়, তবে একইভাবে দ্বৈত কৌশলের মাধ্যমে দুই পরাশক্তির সঙ্গেই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক দক্ষতার পাশাপাশি উৎপাদন স্বচ্ছতাও জরুরি।

বাংলাদেশ কোথায় পিছিয়ে পড়ছে?

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের ওপর দীর্ঘদিন নির্ভর করে এসেছে। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন এবং ট্রান্সশিপমেন্ট বিষয়ে স্পষ্ট নীতি না থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা কমছে।

বিজিএমইএ-এর তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি মাত্র ১.৪ শতাংশ, যেখানে আগের বছরে তা ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, কারণ শ্রম অধিকারের উন্নয়ন ও পরিবেশগত মান সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার বলেন,

“বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প একটি সফলতা হলেও তার ভিত্তি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ছে। শ্রম অধিকার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিদেশি ক্রেতারা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকবে।”

বাজার বৈচিত্র্য ও প্রতিযোগিতা: ভিয়েতনামের চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশের সুযোগ

বিশ্বব্যাপী বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী এখন ভিয়েতনাম, ভারত ও তুরস্ক। ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ (Free Trade Agreement) করে শুল্কহীন রপ্তানির সুবিধা নিচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনও এলডিসি স্ট্যাটাস হারানোর পর নতুন বাণিজ্য সুবিধার জন্য প্রস্তুত নয়।

বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন,

“আমরা এখনও নির্দিষ্ট বাজারে আটকে আছি। সময় এসেছে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সক্রিয় বাণিজ্য প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে নতুন বাজার খোঁজার।”

স্বচ্ছতাসংলাপ ও শ্রমমান: করণীয় কী?

নিয়মিত সংলাপ ও কূটনৈতিক সক্রিয়তা

বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য প্রধান ক্রেতা দেশের সঙ্গে নিয়মিত রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনায় থাকতে হবে।

ট্রান্সশিপমেন্ট ও উৎপাদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত

ভুয়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেবেল বন্ধে এবং উৎস দেশ শনাক্তের ট্রেসেবিলিটি বাড়াতে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

শ্রম অধিকার ও পরিবেশগত মান উন্নয়ন

ILO-এর নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠিত শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দক্ষ আমলাতন্ত্র

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে স্বচ্ছ নির্বাচন, নিরপেক্ষ নীতি প্রণয়ন এবং দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা এখন জরুরি।

সময় এখনও আছেকিন্তু জানালা সংকীর্ণ

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম, কিন্তু স্থবির নীতিমালা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বাজার বৈচিত্র্যহীনতা এই অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলছে। এখনই কার্যকর কূটনীতি, স্পষ্ট বাণিজ্য কৌশল ও শ্রম অধিকার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হবে—না হলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের স্থান দ্রুত সংকুচিত হবে।

ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা: বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের জন্য সতর্কবার্তা

০৪:৫৯:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

অনিশ্চয়তা ও চাপে বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ভয়াবহ চাপে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান শুল্কযুদ্ধ, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলার পুনর্গঠন এবং দেশের অস্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ পরিবেশ মিলে রপ্তানিনির্ভর গার্মেন্টস খাতকে একপ্রকার ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী ভিয়েতনামের সংকট থেকে বাংলাদেশ মূল্যবান শিক্ষা নিতে পারে।

ভিয়েতনামের শিক্ষা: দুই পরাশক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষা

ভিয়েতনাম চীনের কাছ থেকে ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করে এবং রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। অথচ মার্কিন প্রশাসন চায় ভিয়েতনাম যেন চীনের তৈরি পণ্যের উৎপত্তি দেশ গোপন করে রপ্তানি বন্ধ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে এই নিয়ে ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি এসেছে। ফলে এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে চীনের ওপর নির্ভরতা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশকে যদি বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হয়, তবে একইভাবে দ্বৈত কৌশলের মাধ্যমে দুই পরাশক্তির সঙ্গেই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক দক্ষতার পাশাপাশি উৎপাদন স্বচ্ছতাও জরুরি।

বাংলাদেশ কোথায় পিছিয়ে পড়ছে?

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের ওপর দীর্ঘদিন নির্ভর করে এসেছে। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন এবং ট্রান্সশিপমেন্ট বিষয়ে স্পষ্ট নীতি না থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা কমছে।

বিজিএমইএ-এর তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি মাত্র ১.৪ শতাংশ, যেখানে আগের বছরে তা ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, কারণ শ্রম অধিকারের উন্নয়ন ও পরিবেশগত মান সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার বলেন,

“বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প একটি সফলতা হলেও তার ভিত্তি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ছে। শ্রম অধিকার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিদেশি ক্রেতারা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকবে।”

বাজার বৈচিত্র্য ও প্রতিযোগিতা: ভিয়েতনামের চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশের সুযোগ

বিশ্বব্যাপী বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী এখন ভিয়েতনাম, ভারত ও তুরস্ক। ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ (Free Trade Agreement) করে শুল্কহীন রপ্তানির সুবিধা নিচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনও এলডিসি স্ট্যাটাস হারানোর পর নতুন বাণিজ্য সুবিধার জন্য প্রস্তুত নয়।

বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন,

“আমরা এখনও নির্দিষ্ট বাজারে আটকে আছি। সময় এসেছে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সক্রিয় বাণিজ্য প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে নতুন বাজার খোঁজার।”

স্বচ্ছতাসংলাপ ও শ্রমমান: করণীয় কী?

নিয়মিত সংলাপ ও কূটনৈতিক সক্রিয়তা

বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য প্রধান ক্রেতা দেশের সঙ্গে নিয়মিত রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনায় থাকতে হবে।

ট্রান্সশিপমেন্ট ও উৎপাদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত

ভুয়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেবেল বন্ধে এবং উৎস দেশ শনাক্তের ট্রেসেবিলিটি বাড়াতে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

শ্রম অধিকার ও পরিবেশগত মান উন্নয়ন

ILO-এর নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠিত শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দক্ষ আমলাতন্ত্র

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে স্বচ্ছ নির্বাচন, নিরপেক্ষ নীতি প্রণয়ন এবং দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা এখন জরুরি।

সময় এখনও আছেকিন্তু জানালা সংকীর্ণ

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম, কিন্তু স্থবির নীতিমালা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বাজার বৈচিত্র্যহীনতা এই অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলছে। এখনই কার্যকর কূটনীতি, স্পষ্ট বাণিজ্য কৌশল ও শ্রম অধিকার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হবে—না হলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের স্থান দ্রুত সংকুচিত হবে।