০৫:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

চট্টগ্রাম থেকে খুলনা: সমগ্র নদী ও সমুদ্র এলাকার মানুষ দুর্ভোগে

গভীর নিম্নচাপের ছোবলে উপকূল

২০২৫ সালের ২৯ মে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিমে সৃষ্টি হওয়া একটি গভীর নিম্নচাপ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত, দমকা হাওয়া এবং সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রাসহ উপকূলীয় সব সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। উত্তর বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই নয়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, জীবিকা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও পতেঙ্গা: শহরের জলপথে হুমকি

চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র কর্ণফুলী নদীর পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকে। কাপ্তাই বাঁধ কর্তৃপক্ষ একটি ‘নিয়ন্ত্রিত পানি নির্গমন’-এর পরিকল্পনা নেয়, যাতে নদীতে আকস্মিক পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ করা যায়। তবে পতেঙ্গা এলাকায়, যেখানে নদী সাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, সেখানে উত্তাল সাগর ঢেউয়ের আঘাতে পাড় ভাঙনের শঙ্কা বাড়তে থাকে।

স্থানীয় দোকানপাট, হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ব্যবসা থমকে যায়। জেলেরা দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ছোট ছোট নৌকাগুলো নোঙর করে রাখা হলেও সেগুলো বাঁচবে কিনা, তা নিয়ে জেলে পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

কক্সবাজার ও টেকনাফ: প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ

দক্ষিণাঞ্চলের এই এলাকাগুলো ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপের সম্মুখভাগে পড়ে। কক্সবাজারে উঁচু ঢেউ আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাতে শহরের প্রধান সড়কগুলো অচল হয়ে পড়ে। কলাতলী, লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্টে দোকানগুলো বন্ধ থাকে, পর্যটকশূন্য সৈকতে কেবল দুর্যোগের ছাপ।

টেকনাফে, যেখানে একদিনেই ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়, সেখানকার পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি হয়। উখিয়া, বাহারছড়া ও হ্নীলার মতো অঞ্চলে শত শত মানুষ বাঁশ-কাঠের তৈরি ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে ওঠে। মায়েরা শিশুদের কোলে নিয়ে রাত কাটান অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।

 

মংলাশিবসাপশুর ও রূপসা: দক্ষিণাঞ্চলের নদীপথে সতর্কবার্তা

মংলা ও তার আশপাশের নদীগুলো—বিশেষ করে পশুর, শিবসা ও রূপসা—পানির চাপে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকাগুলো নদীর পাড়ে নিরাপদে রাখা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই স্রোতের ধাক্কায় সেগুলো উল্টে যায়। বুড়িরডাঙ্গা ও চিলা ইউনিয়নের কৃষক ও জেলেরা নদীতে কাজ হারিয়ে পড়েন সংকটে।

পানির স্রোতে কিছু বাঁধ ভেঙে পড়ে, যার ফলে আশেপাশের বসতি ও ফসলের মাঠে হঠাৎ জল উঠে যায়। অনেকেই জুতা খুলে কোমরসমান পানির মধ্যে নেমে ঘরে ফিরে যান, কিন্তু পানির চাপে উঠানে রাখা সবজি ও ধানের গাদা নষ্ট হয়ে যায়।

শিশুরা ও শিক্ষা: অচল হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ

উপকূলীয় এই দুর্যোগ শিশুদের জন্য একটি দ্বিগুণ সংকট বয়ে আনে। একদিকে তারা তাদের বাড়িঘর, নিরাপত্তা এবং খেলাধুলার পরিবেশ হারায়, অন্যদিকে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকে, অনেক স্কুল আবার অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, “আমাদের স্কুলে ক্লাসের পরিবর্তে এখন প্রায় ৩০০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা আসার কোনো পরিবেশই নেই।”

শিশুরা পড়াশোনা ভুলে খাদ্য, পানীয় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যেসব জায়গায় অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ইন্টারনেট সংকটে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

সবজি ও কৃষিপণ্য: দুর্যোগে কৃষকের সর্বনাশ

গভীর নিম্নচাপের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন উপকূলীয় এলাকার কৃষকেরা। মে মাসের শেষদিকে সাধারণত টমেটো, মরিচ, শসা, ঝিঙে, কুমড়া, বেগুন, ধনে ও শাকসবজি চাষের সময়। কিন্তু বৃষ্টির কারণে মাঠগুলো ডুবে যায়, তরতাজা গাছগুলো পচে যায় বা ভেসে যায়।

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার কৃষক আবদুল মালেক বলেন, “এই বছর আমার এক বিঘা জমিতে টমেটো আর কুমড়া লাগিয়েছিলাম। পানিতে একটাও বাঁচলো না। পেছনে ২০ হাজার টাকা লোন আছে। এখন কী করব?”

স্থানীয় হাটগুলোতে সবজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূল্য বেড়ে যায় দ্বিগুণ, যা শহরের ভোক্তাদের জন্যও এক ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কা।

শহরের দুরবস্থা: বিদ্যুৎ নেইরাস্তাও ডুবে

শহরের বড় বড় এলাকাতেও এই নিম্নচাপের প্রভাব স্পষ্ট। চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড়, বায়েজিদ, মুরাদপুর ও পাঁচলাইশে জলাবদ্ধতা এতটাই চরমে পৌঁছায় যে রিকশা-অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রাইভেট গাড়ি চললেও সেগুলোর ইঞ্জিন বারবার পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়।

সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে যায় বহু এলাকায়। মোবাইল চার্জ, খাবার রান্না, পানির পাম্প চালানো—সব কিছুই থেমে যায়। হাজার হাজার মানুষ অন্ধকারে রাত কাটায়।

নারী ও প্রবীণদের দুর্ভোগ

এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় গর্ভবতী নারী ও প্রবীণদের। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন না। জলাবদ্ধ রাস্তায় হেঁটে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক জায়গায় ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে বৃদ্ধদের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। টেকনাফের বাহারছড়ায় এক প্রবীণ নারী বলেন, “ওষুধ শেষ, পানি নেই, খাবারও টানাটানি। আমাদের মতো বুড়াদের কষ্ট কেউ বোঝে না।”

ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি জরুরি

বঙ্গোপসাগরের এই গভীর নিম্নচাপ আবারও স্পষ্ট করে দিল যে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এখনো কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। শুধু তাৎক্ষণিক ত্রাণ বিতরণ বা সতর্ক সংকেত যথেষ্ট নয়—এই দুর্যোগ প্রমাণ করেছে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া আমরা নিরাপদ নই।

প্রয়োজনীয় উদ্যোগসমূহ:

  • আধুনিক ও সুনির্দিষ্ট আগাম সতর্কবার্তা
  • দুর্যোগ প্রতিরোধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি
  • নদী ও পাড় রক্ষা প্রকল্প
  • শিশু ও নারীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র
  • কৃষকের জন্য বীমা ও ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি

বাংলাদেশের উপকূলকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এখনই সময় ঝুঁকি হ্রাস এবং জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। এই দুর্যোগ কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়—এটি উন্নয়নের পথচলায় আমাদের অবহেলার প্রতিফলনও। এখন পরিবর্তনের সময়।

চট্টগ্রাম থেকে খুলনা: সমগ্র নদী ও সমুদ্র এলাকার মানুষ দুর্ভোগে

০৬:৫৫:২৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

গভীর নিম্নচাপের ছোবলে উপকূল

২০২৫ সালের ২৯ মে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিমে সৃষ্টি হওয়া একটি গভীর নিম্নচাপ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত, দমকা হাওয়া এবং সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রাসহ উপকূলীয় সব সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। উত্তর বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই নয়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, জীবিকা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও পতেঙ্গা: শহরের জলপথে হুমকি

চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র কর্ণফুলী নদীর পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকে। কাপ্তাই বাঁধ কর্তৃপক্ষ একটি ‘নিয়ন্ত্রিত পানি নির্গমন’-এর পরিকল্পনা নেয়, যাতে নদীতে আকস্মিক পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ করা যায়। তবে পতেঙ্গা এলাকায়, যেখানে নদী সাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, সেখানে উত্তাল সাগর ঢেউয়ের আঘাতে পাড় ভাঙনের শঙ্কা বাড়তে থাকে।

স্থানীয় দোকানপাট, হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ব্যবসা থমকে যায়। জেলেরা দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ছোট ছোট নৌকাগুলো নোঙর করে রাখা হলেও সেগুলো বাঁচবে কিনা, তা নিয়ে জেলে পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

কক্সবাজার ও টেকনাফ: প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ

দক্ষিণাঞ্চলের এই এলাকাগুলো ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপের সম্মুখভাগে পড়ে। কক্সবাজারে উঁচু ঢেউ আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাতে শহরের প্রধান সড়কগুলো অচল হয়ে পড়ে। কলাতলী, লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্টে দোকানগুলো বন্ধ থাকে, পর্যটকশূন্য সৈকতে কেবল দুর্যোগের ছাপ।

টেকনাফে, যেখানে একদিনেই ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়, সেখানকার পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি হয়। উখিয়া, বাহারছড়া ও হ্নীলার মতো অঞ্চলে শত শত মানুষ বাঁশ-কাঠের তৈরি ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে ওঠে। মায়েরা শিশুদের কোলে নিয়ে রাত কাটান অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।

 

মংলাশিবসাপশুর ও রূপসা: দক্ষিণাঞ্চলের নদীপথে সতর্কবার্তা

মংলা ও তার আশপাশের নদীগুলো—বিশেষ করে পশুর, শিবসা ও রূপসা—পানির চাপে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকাগুলো নদীর পাড়ে নিরাপদে রাখা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই স্রোতের ধাক্কায় সেগুলো উল্টে যায়। বুড়িরডাঙ্গা ও চিলা ইউনিয়নের কৃষক ও জেলেরা নদীতে কাজ হারিয়ে পড়েন সংকটে।

পানির স্রোতে কিছু বাঁধ ভেঙে পড়ে, যার ফলে আশেপাশের বসতি ও ফসলের মাঠে হঠাৎ জল উঠে যায়। অনেকেই জুতা খুলে কোমরসমান পানির মধ্যে নেমে ঘরে ফিরে যান, কিন্তু পানির চাপে উঠানে রাখা সবজি ও ধানের গাদা নষ্ট হয়ে যায়।

শিশুরা ও শিক্ষা: অচল হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ

উপকূলীয় এই দুর্যোগ শিশুদের জন্য একটি দ্বিগুণ সংকট বয়ে আনে। একদিকে তারা তাদের বাড়িঘর, নিরাপত্তা এবং খেলাধুলার পরিবেশ হারায়, অন্যদিকে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকে, অনেক স্কুল আবার অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, “আমাদের স্কুলে ক্লাসের পরিবর্তে এখন প্রায় ৩০০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা আসার কোনো পরিবেশই নেই।”

শিশুরা পড়াশোনা ভুলে খাদ্য, পানীয় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যেসব জায়গায় অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ইন্টারনেট সংকটে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

সবজি ও কৃষিপণ্য: দুর্যোগে কৃষকের সর্বনাশ

গভীর নিম্নচাপের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন উপকূলীয় এলাকার কৃষকেরা। মে মাসের শেষদিকে সাধারণত টমেটো, মরিচ, শসা, ঝিঙে, কুমড়া, বেগুন, ধনে ও শাকসবজি চাষের সময়। কিন্তু বৃষ্টির কারণে মাঠগুলো ডুবে যায়, তরতাজা গাছগুলো পচে যায় বা ভেসে যায়।

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার কৃষক আবদুল মালেক বলেন, “এই বছর আমার এক বিঘা জমিতে টমেটো আর কুমড়া লাগিয়েছিলাম। পানিতে একটাও বাঁচলো না। পেছনে ২০ হাজার টাকা লোন আছে। এখন কী করব?”

স্থানীয় হাটগুলোতে সবজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূল্য বেড়ে যায় দ্বিগুণ, যা শহরের ভোক্তাদের জন্যও এক ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কা।

শহরের দুরবস্থা: বিদ্যুৎ নেইরাস্তাও ডুবে

শহরের বড় বড় এলাকাতেও এই নিম্নচাপের প্রভাব স্পষ্ট। চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড়, বায়েজিদ, মুরাদপুর ও পাঁচলাইশে জলাবদ্ধতা এতটাই চরমে পৌঁছায় যে রিকশা-অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রাইভেট গাড়ি চললেও সেগুলোর ইঞ্জিন বারবার পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়।

সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে যায় বহু এলাকায়। মোবাইল চার্জ, খাবার রান্না, পানির পাম্প চালানো—সব কিছুই থেমে যায়। হাজার হাজার মানুষ অন্ধকারে রাত কাটায়।

নারী ও প্রবীণদের দুর্ভোগ

এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় গর্ভবতী নারী ও প্রবীণদের। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন না। জলাবদ্ধ রাস্তায় হেঁটে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক জায়গায় ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে বৃদ্ধদের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। টেকনাফের বাহারছড়ায় এক প্রবীণ নারী বলেন, “ওষুধ শেষ, পানি নেই, খাবারও টানাটানি। আমাদের মতো বুড়াদের কষ্ট কেউ বোঝে না।”

ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি জরুরি

বঙ্গোপসাগরের এই গভীর নিম্নচাপ আবারও স্পষ্ট করে দিল যে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এখনো কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। শুধু তাৎক্ষণিক ত্রাণ বিতরণ বা সতর্ক সংকেত যথেষ্ট নয়—এই দুর্যোগ প্রমাণ করেছে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া আমরা নিরাপদ নই।

প্রয়োজনীয় উদ্যোগসমূহ:

  • আধুনিক ও সুনির্দিষ্ট আগাম সতর্কবার্তা
  • দুর্যোগ প্রতিরোধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি
  • নদী ও পাড় রক্ষা প্রকল্প
  • শিশু ও নারীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র
  • কৃষকের জন্য বীমা ও ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি

বাংলাদেশের উপকূলকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এখনই সময় ঝুঁকি হ্রাস এবং জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। এই দুর্যোগ কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়—এটি উন্নয়নের পথচলায় আমাদের অবহেলার প্রতিফলনও। এখন পরিবর্তনের সময়।