০১:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০১)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫
  • 12

নজরুল

খবর পাইয়া ফরিদপুরের পুলিশ-সাহেব আমাদের প্রিন্সিপাল মহাশয়ের নিকট পত্র লিখিলেন, “নজরুলের মতিগতি গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে: তিনি তাঁহার বক্তৃতায় সরলমতি ছাত্রদিগকে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে খ্যাপাইয়া তুলিবেন। নজরুলকে যদি কলেজে বক্তৃতা করিতে দেওয়া হয়, তবে আই বি পুলিশদেরও কলেজের সভায় উপস্থিত থাকিতে দিতে হইবে।” আমাদের প্রিন্সিপাল কামাখ্যা বাবুর প্রতিও গভর্নমেন্টের সুনজর ছিল না। বহু বৎসর আগে তিনি পুলিশের কোপদৃষ্টিতে অন্তরিন ছিলেন। নজরুলকে দিয়া বক্তৃতা করাইলে পরিণামে কলেজের ক্ষতি হইতে পারে বিবেচনা করিয়া তিনি আমাদিগকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “নজরুলকে লইয়া কলেজে যে সভা করার অনুমতি দিয়েছিলাম, তা প্রত্যাহার করলাম।”

আমরা মুষড়িয়া পড়িলাম। সবাই মুখ মলিন করিয়া কবির কাছে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের অবস্থা দেখিয়া কবি বলিলেন, “কুছ পরওয়া নেই। উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে সভা কর। আমি সেইখানে বক্তৃতা দিব।”

তখন আমাদিগকে আর পায় কে। দশ-বিশটা কেরোসিনের টিন বাজাইতে বাজাইতে সমস্ত শহর ভরিয়া কবির বক্তৃতা দেওয়ার কথা প্রচার করিলাম। সন্ধ্যাবেলা অম্বিকা হলের ময়দানে লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার নর-নারী আসিয়া জমায়েত হইলেন কবিকণ্ঠের বাণী শুনিবার জন্য।

সেই সভায় কবিকে নূতন রূপে পাইলাম। এতদিন কবি শুধু দেশাত্মবোধের কথাই বলিতেন। আজ কবি বলিলেন সাম্যবাদের বাণী। কবি যখন ‘উপরে চাষী জগৎবাসী, ধর কষে লাঙ্গল’ অথবা ‘আমরা শ্রমিকদল, ওরে আমরা শ্রমিকদল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সমবেত জনতা কবির ভাবতরঙ্গের সঙ্গে উদ্বেলিত হইতেছিল। সর্বশেষে কবি তাঁহার বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতা আবৃত্তি করিলেন। সে কী আবৃত্তি। প্রতিটি কথা কবির কণ্ঠের অপূর্ব ভাবচ্ছটায় উচ্ছ্বসিত হইয়া সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গিয়া ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিতেছিল। মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল, কবি-কণ্ঠ হইতে যেন অগ্নিবর্ষণ হইতেছে। সেই আগুনে যাহা কিছু ন্যায়ের বিরোধী, সমস্ত পুড়িয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে।

সেই সভায় আমি বলিয়াছিলাম, ইনি আমাদের কবি; ইঁহার অন্তর হইতে যে বাণী বাহির হইতেছে, সেই বাণীর সঙ্গে আমাদের যুগযুগান্তরের দুঃখ-বেদনা ও কান্না মিশ্রিত হইয়া আছে; শত জালিমের অত্যাচারে শত শোষকের পীড়নে আমাদের অন্তরে যে অগ্নিময় হাহাকার শত লেলিহান জিহ্বা মেলিয়া যুগযুগান্তরের অপমানের গ্লানিতে তাপ সঞ্চয় করিতেছিল, এই কবির বাণীতে আজ তারা রূপ পাইল। এই কবির অন্তর হইতে বাণীর বিহঙ্গেরা অগ্নির পাখা বিস্তার করিয়া আজ দিগ্‌-দিগন্তে সর্বত্যাগের গান গাহিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কাব্য এই কবির কাছে ভাব-বিলাসের বস্তু নয়। তাঁহার কাব্যলোক হইতে যে-বাণী স্বতঃই উৎসারিত হইতেছে নিজের জীবনকে ইনি সেই বাণীনিঃসৃত পথে পরিচালিত করিতেছেন।

আমাদের আসমানের সুবেহ সাদেকে, ইনি উদীয়মান শুকতারা। ইহার ত্যাগের রক্ত-রঙিমায় স্নান করিয়া নূতন প্রভাতের অরুণ আলোক দিগ্‌-দিগন্ত আলোকিত করিয়া তুলিবে। আমার বক্তৃতার শেষের দিকে আমি কলেজের প্রিন্সিপাল মহাশয়ের কঠোর সমালোচনা করিয়াছিলাম। পরদিন তিনি আমাকে ডাকাইয়া তাহার জন্য কৈফিয়ত চাহিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, “আপনার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি, তারই জোরে সভায় আপনার বিরূপ সমালোচনা করতে সাহসী হয়েছিলাম। আপনিই তো বলে থাকেন, আমরা রাজভয়ে ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হব না। কিন্তু পুলিশ-সাহেবের একখানা পত্র পেয়ে আপনি আপনার পূর্ব-অনুমতি ফিরিয়ে নিলেন।”

আমার কথা শুনিয়া তিনি হাসিয়া উঠিলেন। বুঝিলাম, তিনি আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। বস্তুত তাঁহার মতো ক্ষমাসুন্দর শিক্ষক জীবনে খুব কমই দেখিয়াছি।

ইহার পরে আরও একবার কবি আমার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমাদের নদীতীরের বাঁশঝাড়ের ছায়াতলে বসিয়া আমরা দুই কবি মিলিয়া উন্মুক্ত প্রকৃতির রহস্যদেশ হইতে মণি-মাণিক্য কুড়াইয়া আনিব। কবিও তাহাতে রাজি হইয়াছিলেন। কিন্তু ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব মোটর হাঁকাইয়া আসিয়া একদিন কবিকে শহরে লইয়া আসিলেন। আমার নদীতীরের চখা-চখির ডাকাডাকি কবিকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০১)

১১:০০:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫

নজরুল

খবর পাইয়া ফরিদপুরের পুলিশ-সাহেব আমাদের প্রিন্সিপাল মহাশয়ের নিকট পত্র লিখিলেন, “নজরুলের মতিগতি গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে: তিনি তাঁহার বক্তৃতায় সরলমতি ছাত্রদিগকে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে খ্যাপাইয়া তুলিবেন। নজরুলকে যদি কলেজে বক্তৃতা করিতে দেওয়া হয়, তবে আই বি পুলিশদেরও কলেজের সভায় উপস্থিত থাকিতে দিতে হইবে।” আমাদের প্রিন্সিপাল কামাখ্যা বাবুর প্রতিও গভর্নমেন্টের সুনজর ছিল না। বহু বৎসর আগে তিনি পুলিশের কোপদৃষ্টিতে অন্তরিন ছিলেন। নজরুলকে দিয়া বক্তৃতা করাইলে পরিণামে কলেজের ক্ষতি হইতে পারে বিবেচনা করিয়া তিনি আমাদিগকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “নজরুলকে লইয়া কলেজে যে সভা করার অনুমতি দিয়েছিলাম, তা প্রত্যাহার করলাম।”

আমরা মুষড়িয়া পড়িলাম। সবাই মুখ মলিন করিয়া কবির কাছে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের অবস্থা দেখিয়া কবি বলিলেন, “কুছ পরওয়া নেই। উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে সভা কর। আমি সেইখানে বক্তৃতা দিব।”

তখন আমাদিগকে আর পায় কে। দশ-বিশটা কেরোসিনের টিন বাজাইতে বাজাইতে সমস্ত শহর ভরিয়া কবির বক্তৃতা দেওয়ার কথা প্রচার করিলাম। সন্ধ্যাবেলা অম্বিকা হলের ময়দানে লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার নর-নারী আসিয়া জমায়েত হইলেন কবিকণ্ঠের বাণী শুনিবার জন্য।

সেই সভায় কবিকে নূতন রূপে পাইলাম। এতদিন কবি শুধু দেশাত্মবোধের কথাই বলিতেন। আজ কবি বলিলেন সাম্যবাদের বাণী। কবি যখন ‘উপরে চাষী জগৎবাসী, ধর কষে লাঙ্গল’ অথবা ‘আমরা শ্রমিকদল, ওরে আমরা শ্রমিকদল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সমবেত জনতা কবির ভাবতরঙ্গের সঙ্গে উদ্বেলিত হইতেছিল। সর্বশেষে কবি তাঁহার বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতা আবৃত্তি করিলেন। সে কী আবৃত্তি। প্রতিটি কথা কবির কণ্ঠের অপূর্ব ভাবচ্ছটায় উচ্ছ্বসিত হইয়া সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গিয়া ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিতেছিল। মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল, কবি-কণ্ঠ হইতে যেন অগ্নিবর্ষণ হইতেছে। সেই আগুনে যাহা কিছু ন্যায়ের বিরোধী, সমস্ত পুড়িয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে।

সেই সভায় আমি বলিয়াছিলাম, ইনি আমাদের কবি; ইঁহার অন্তর হইতে যে বাণী বাহির হইতেছে, সেই বাণীর সঙ্গে আমাদের যুগযুগান্তরের দুঃখ-বেদনা ও কান্না মিশ্রিত হইয়া আছে; শত জালিমের অত্যাচারে শত শোষকের পীড়নে আমাদের অন্তরে যে অগ্নিময় হাহাকার শত লেলিহান জিহ্বা মেলিয়া যুগযুগান্তরের অপমানের গ্লানিতে তাপ সঞ্চয় করিতেছিল, এই কবির বাণীতে আজ তারা রূপ পাইল। এই কবির অন্তর হইতে বাণীর বিহঙ্গেরা অগ্নির পাখা বিস্তার করিয়া আজ দিগ্‌-দিগন্তে সর্বত্যাগের গান গাহিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কাব্য এই কবির কাছে ভাব-বিলাসের বস্তু নয়। তাঁহার কাব্যলোক হইতে যে-বাণী স্বতঃই উৎসারিত হইতেছে নিজের জীবনকে ইনি সেই বাণীনিঃসৃত পথে পরিচালিত করিতেছেন।

আমাদের আসমানের সুবেহ সাদেকে, ইনি উদীয়মান শুকতারা। ইহার ত্যাগের রক্ত-রঙিমায় স্নান করিয়া নূতন প্রভাতের অরুণ আলোক দিগ্‌-দিগন্ত আলোকিত করিয়া তুলিবে। আমার বক্তৃতার শেষের দিকে আমি কলেজের প্রিন্সিপাল মহাশয়ের কঠোর সমালোচনা করিয়াছিলাম। পরদিন তিনি আমাকে ডাকাইয়া তাহার জন্য কৈফিয়ত চাহিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, “আপনার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি, তারই জোরে সভায় আপনার বিরূপ সমালোচনা করতে সাহসী হয়েছিলাম। আপনিই তো বলে থাকেন, আমরা রাজভয়ে ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হব না। কিন্তু পুলিশ-সাহেবের একখানা পত্র পেয়ে আপনি আপনার পূর্ব-অনুমতি ফিরিয়ে নিলেন।”

আমার কথা শুনিয়া তিনি হাসিয়া উঠিলেন। বুঝিলাম, তিনি আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। বস্তুত তাঁহার মতো ক্ষমাসুন্দর শিক্ষক জীবনে খুব কমই দেখিয়াছি।

ইহার পরে আরও একবার কবি আমার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমাদের নদীতীরের বাঁশঝাড়ের ছায়াতলে বসিয়া আমরা দুই কবি মিলিয়া উন্মুক্ত প্রকৃতির রহস্যদেশ হইতে মণি-মাণিক্য কুড়াইয়া আনিব। কবিও তাহাতে রাজি হইয়াছিলেন। কিন্তু ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব মোটর হাঁকাইয়া আসিয়া একদিন কবিকে শহরে লইয়া আসিলেন। আমার নদীতীরের চখা-চখির ডাকাডাকি কবিকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।

 

চলবে…..