রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংকট
তুরস্কের দীর্ঘদিনের শাসক রজেপ তায়্যেব এরদোয়ান এখন নিজের রাজনৈতিক বাঁচা-মরার লড়াইয়ে। ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ, তিনি ইস্তানবুলের জনপ্রিয় মেয়র একরেম ইমামোগূলুর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করান। অভিযোগ ছিল দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার—যদিও সেগুলো ছিল অমূলক। এই গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ। ইস্তানবুলে কয়েকটি মিছিলে অংশ নেয় এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ—তরুণরাই ছিলেন এই আন্দোলনের অগ্রভাগে।
জনস্বার্থে আস্থাহীনতা ও দমননীতি
ইমামোগূলু এরদোয়ানের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন জনপ্রিয়, আধুনিক ও ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতি পদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী। এরদোয়ান জনস্বার্থের চেয়ে নিজ রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখাকেই প্রাধান্য দিতে থাকেন। তাঁর একনায়কতান্ত্রিক কৌশলে দেশজুড়ে মানুষের মাঝে ক্ষোভ দানা বাঁধে। ২০২৪ সালে Pew Research-এর জরিপে দেখা যায়, তুরস্কের ৫৫ শতাংশ নাগরিক তাঁর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছিলেন।
আন্দোলনের নতুন মাত্রা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়
ইমামোগূলুর গ্রেপ্তার কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও দেশকে নাড়া দেয়। শুরু হয় সরকারপন্থী ব্যবসায়ীদের বর্জন, অসহযোগ আন্দোলন এবং অনলাইন প্রতিবাদ। একের পর এক ইমামোগূলুর বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এর সবকিছুই দেখায় এক আত্মবিশ্বাসহীন ও ভীত শাসকের মুখ।

শক্তি ধরে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা
এরদোয়ান ইতিপূর্বেও বিরোধীদের দমন করেছেন। কুর্দ নেত্রী দেমিরতাসকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ৪৫ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। একসময় সেনাবাহিনীকে শাসন থেকে সরিয়ে গণতন্ত্র আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও, পরে তিনিই রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেন। গেজি পার্ক আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ পর্যন্ত, তিনি আন্দোলনগুলো দমন করেছেন বর্বরভাবে।
আইনশাসনের পতন ও বিচারহীনতা
২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ান ‘জরুরি অবস্থা’র দোহাই দিয়ে এক সপ্তাহে ১ লাখ ২৫ হাজার কর্মচারী বরখাস্ত করেন। ২০১৭ সালে তিনি সংবিধান বদলে প্রেসিডেন্টি শাসনব্যবস্থা চালু করেন, যা সংসদের ক্ষমতা কার্যত শূন্য করে দেয়। বিচার বিভাগকেও ক্ষমতার আওতায় আনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন তুর্কি কারাগারগুলোতে সাংবাদিক, বিরোধী রাজনীতিক, শিক্ষকসহ হাজার হাজার মানুষ বন্দি।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সংকোচন
২০২৫ সালে শক্তিশালী ব্যবসায়িক সংগঠন TUSIAD সরকারের সমালোচনা করলে এরদোয়ান তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দেন। ইমামোগূলুর বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিও বাতিল করা হয়, যাতে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে লড়াই করতে না পারেন। CHP দল যখন তাঁকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রতিরোধ ও গণঅভ্যুত্থান
এরদোয়ানের দমননীতি এবার ফলপ্রসূ হয়নি। CHP ইমামোগূলুর সমর্থনে এক প্রতীকী ‘প্রাথমিক নির্বাচন’ আয়োজন করে ২৩ মার্চ, যেখানে ১.৫ কোটি মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়। KONDA জরিপে দেখা যায়, ৬৭% নাগরিক এরদোয়ানের পুনঃনির্বাচনকে ক্ষতিকর বলে মনে করছেন। বন্দি থেকেও ইমামোগূলু জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন এবং তাঁর সঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম বা ভাস্লাভ হ্যাভেলের তুলনা টানা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ধস
ইমামোগূলুর গ্রেপ্তারের পর তুর্কি লিরা রেকর্ড সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৪৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ খরচ করতে হয়, শেয়ারবাজারে একাধিকবার ‘সার্কিট ব্রেকার’ চালু করা হয়। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, কারণ আইনের শাসন লঙ্ঘনের কারণে তুরস্ক আর নিরাপদ নয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে পরিবর্তন
ডোনাল্ড ট্রাম্প এরদোয়ানকে সমর্থন করলেও বাইডেন প্রশাসন নিরব থাকে। তবে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেই রাজনীতি করা এরদোয়ান এবার আর সেই কৌশল প্রয়োগ করতে পারছেন না।

কুর্দ শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা
২০২৫ সালের মে মাসে PKK সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তবে এরদোয়ানের প্রতিক্রিয়া ছিল অস্পষ্ট ও শাস্তিমূলক। কুর্দ নেতারা চান আইনশাসন, ভাষার অধিকার এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো—যা এরদোয়ানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিপন্থী।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্য পতন
এরদোয়ান যদি ক্ষমতা ধরে রাখতে চান, তবে তাঁকে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে অথবা আগাম নির্বাচনের পথে যেতে হবে। তবে জনমতের পরিবর্তন ও বিরোধীদের পুনর্গঠনের ফলে তাঁর জয় নিশ্চিত নয়। বরং অতীত কৌশল—গ্রেপ্তার, দমন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ—নিয়ে তিনি আরও কঠোর হতে পারেন, কিন্তু সেটাই তাঁকে চূড়ান্তভাবে একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাবে।
শেষ কথা
তুরস্কের ইতিহাসে সম্ভবত এরদোয়ান স্মরণীয় হবেন সেই নেতারূপে, যিনি সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী হয়েও নিজের অহংকার ও ভয়ের কারণে নিজেই নিজের পতন ঘটিয়েছেন। সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিলে উত্তরাধিকারের একটি ইতিবাচক অধ্যায় লেখা যেত। কিন্তু এরদোয়ান এখনো সেই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে রাজি নন—এবং তুরস্ক ক্রমেই প্রবেশ করছে এক দুঃসহ, দমনমূলক সময়ে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















