০২:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধি: ভোক্তা ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সংকট

দাম বাড়ল বাজেটের আগেই

জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগেই বাংলাদেশে বোতলজাত পানির দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। এই দাম বৃদ্ধিতে ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এবং বিষয়টি নজরে এনেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর।

লাভ বাড়লেও উৎপাদন খরচ বাড়েনি

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫০০ মিলি বোতল পানির দাম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকায় পৌঁছেছে—যা ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি। কোম্পানিগুলো দাবি করেছে, আমদানি ব্যয় ও মুদ্রা বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াই দাম বাড়ানোর কারণ। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, উৎপাদন খরচ খুব সামান্যই বেড়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, কোকা-কোলার ‘কিনলে’ ব্র্যান্ডের উৎপাদন খরচ প্রতি বোতলে মাত্র ১.৬২৪ টাকা বেড়েছে, অথচ তাদের লাভ বেড়েছে ২১২ শতাংশ। একইভাবে, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ‘স্পা’ ব্র্যান্ড মাত্র ১৮.৩৩ শতাংশ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিপরীতে ৪২০ শতাংশ লাভ করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি) জানিয়েছে, কোম্পানিগুলো ২০ টাকা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে, অথচ পাইকারি মূল্য ১১-১২ টাকার মধ্যে। এতে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ মুনাফার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ভোক্তাদের উপর চাপ বাড়ছে

এই দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর। অনেকেই শহরের পানির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বোতলজাত পানির উপর নির্ভর করেন। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছে।

এর ফলে ভোক্তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। আগের তুলনায় সাশ্রয়ী বিকল্প এটিএম ওয়াটারের বিক্রি ১৫ শতাংশ কমে গেছে, কারণ তার দাম ৪০ পয়সা থেকে এক লাফে ৮০ পয়সা প্রতি লিটারে পৌঁছেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ভোক্তারা পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত পানি পেতে আগ্রহী, তবে ভালো দাম ও গুণগত মান পেলে তারা ব্র্যান্ড পরিবর্তন করতেও দ্বিধা করেন না।

বাজারের বাস্তবতা

বাংলাদেশে বোতলজাত পানির বাজারে প্রধান ব্র্যান্ডগুলো হলো: মাম, ফ্রেশ, কিনলে ও অ্যাকুফিনা। এই কোম্পানিগুলো প্রতি মাসে ৬ কোটি ৩০ লাখ লিটারের বেশি বোতলজাত পানি সরবরাহ করে এবং প্রতি বছর বাজারে ১০-১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে সম্প্রতি দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যবসায়িক খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিসিসি বলেছে, কিছু কোম্পানি অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে প্রতিযোগিতার ন্যায্যতা নষ্ট করছে এবং ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এজন্য ডিএনসিআরপি (জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর)-কে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

নীতিগত ও আইনগত দিক

বিসিসি বলেছে, ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২’ লঙ্ঘনের প্রমাণ রয়েছে। কারণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে, যাতে ভোক্তারা ন্যায্য দামে পণ্য পেতে পারেন।

এই পরিস্থিতি আবারও দেশের পানি অবকাঠামোগত দুর্বলতা তুলে ধরেছে। ওয়াসা বারবার পানির শুল্ক বাড়ালেও শহরের অনেক এলাকায় নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

উপসংহার: ভোক্তার স্বার্থ বনাম মুনাফার খেলা

বাংলাদেশে বাজেট ঘোষণার আগে বোতলজাত পানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া একটি গভীর সংকেত বহন করে—যেখানে কর্পোরেট মুনাফার লোভ ও সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। কোম্পানিগুলো বিশাল পরিমাণ মুনাফা করছে, অথচ সাধারণ ভোক্তা দামের বোঝা বইছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাই কঠোরভাবে প্রতিযোগিতা আইন বাস্তবায়ন, পানি সরবরাহে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধি: ভোক্তা ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সংকট

০৪:১২:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫

দাম বাড়ল বাজেটের আগেই

জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগেই বাংলাদেশে বোতলজাত পানির দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। এই দাম বৃদ্ধিতে ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এবং বিষয়টি নজরে এনেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর।

লাভ বাড়লেও উৎপাদন খরচ বাড়েনি

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫০০ মিলি বোতল পানির দাম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকায় পৌঁছেছে—যা ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি। কোম্পানিগুলো দাবি করেছে, আমদানি ব্যয় ও মুদ্রা বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াই দাম বাড়ানোর কারণ। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, উৎপাদন খরচ খুব সামান্যই বেড়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, কোকা-কোলার ‘কিনলে’ ব্র্যান্ডের উৎপাদন খরচ প্রতি বোতলে মাত্র ১.৬২৪ টাকা বেড়েছে, অথচ তাদের লাভ বেড়েছে ২১২ শতাংশ। একইভাবে, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ‘স্পা’ ব্র্যান্ড মাত্র ১৮.৩৩ শতাংশ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিপরীতে ৪২০ শতাংশ লাভ করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি) জানিয়েছে, কোম্পানিগুলো ২০ টাকা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে, অথচ পাইকারি মূল্য ১১-১২ টাকার মধ্যে। এতে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ মুনাফার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ভোক্তাদের উপর চাপ বাড়ছে

এই দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর। অনেকেই শহরের পানির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বোতলজাত পানির উপর নির্ভর করেন। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছে।

এর ফলে ভোক্তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। আগের তুলনায় সাশ্রয়ী বিকল্প এটিএম ওয়াটারের বিক্রি ১৫ শতাংশ কমে গেছে, কারণ তার দাম ৪০ পয়সা থেকে এক লাফে ৮০ পয়সা প্রতি লিটারে পৌঁছেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ভোক্তারা পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত পানি পেতে আগ্রহী, তবে ভালো দাম ও গুণগত মান পেলে তারা ব্র্যান্ড পরিবর্তন করতেও দ্বিধা করেন না।

বাজারের বাস্তবতা

বাংলাদেশে বোতলজাত পানির বাজারে প্রধান ব্র্যান্ডগুলো হলো: মাম, ফ্রেশ, কিনলে ও অ্যাকুফিনা। এই কোম্পানিগুলো প্রতি মাসে ৬ কোটি ৩০ লাখ লিটারের বেশি বোতলজাত পানি সরবরাহ করে এবং প্রতি বছর বাজারে ১০-১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে সম্প্রতি দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যবসায়িক খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিসিসি বলেছে, কিছু কোম্পানি অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে প্রতিযোগিতার ন্যায্যতা নষ্ট করছে এবং ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এজন্য ডিএনসিআরপি (জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর)-কে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

নীতিগত ও আইনগত দিক

বিসিসি বলেছে, ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২’ লঙ্ঘনের প্রমাণ রয়েছে। কারণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে, যাতে ভোক্তারা ন্যায্য দামে পণ্য পেতে পারেন।

এই পরিস্থিতি আবারও দেশের পানি অবকাঠামোগত দুর্বলতা তুলে ধরেছে। ওয়াসা বারবার পানির শুল্ক বাড়ালেও শহরের অনেক এলাকায় নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

উপসংহার: ভোক্তার স্বার্থ বনাম মুনাফার খেলা

বাংলাদেশে বাজেট ঘোষণার আগে বোতলজাত পানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া একটি গভীর সংকেত বহন করে—যেখানে কর্পোরেট মুনাফার লোভ ও সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। কোম্পানিগুলো বিশাল পরিমাণ মুনাফা করছে, অথচ সাধারণ ভোক্তা দামের বোঝা বইছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাই কঠোরভাবে প্রতিযোগিতা আইন বাস্তবায়ন, পানি সরবরাহে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।