বিদেশি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া বার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বুধবার এক নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির ঘোষণা দিয়েছেন, যা এমন বিদেশি কর্মকর্তাদের ওপর প্রযোজ্য হবে যারা আমেরিকান নাগরিকদের অনলাইন মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণে জড়িত বলে তিনি অভিযোগ করছেন।
রুবিও এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, “অনেকদিন ধরেই আমেরিকানদের মতপ্রকাশের অধিকার চর্চার কারণে বিদেশি কর্তৃপক্ষদের হাতে জরিমানা, হয়রানি এমনকি অভিযোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আজ আমি এক নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি ঘোষণা করছি, যা সেইসব বিদেশি কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে, যারা আমেরিকানদের সেন্সর করার সঙ্গে জড়িত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমেরিকান জীবনের অন্যতম মৌলিক অধিকার — এবং এতে বিদেশি সরকারের কোনো অধিকার নেই।”
ইউরোপকে লক্ষ্য করে ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রশাসন ইউরোপসহ বৈশ্বিক মিত্রদের ওপর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউরোপীয় নেতাদের সেন্সরশিপের অভিযোগে তীব্র সমালোচনা করেন। সেটিই ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম প্রথম বড় পররাষ্ট্রনীতি বার্তা।
রুবিও বুধবার বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তারা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন বিশ্বব্যাপী কনটেন্ট মডারেশন নিয়ম মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে, যার প্রভাব সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর পড়ে।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে অবস্থানরত কোনো মার্কিন নাগরিক বা বাসিন্দার বিরুদ্ধে কেবলমাত্র আমেরিকান সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য বিদেশি সরকার যদি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে বা হুমকি দেয়, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। একইভাবে, বিদেশি সরকারের পক্ষ থেকে যদি মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেন্সরশিপে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়, তা আমাদের সার্বভৌমতার পরিপন্থী।”
ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে কড়া হুঁশিয়ারি
আরেকটি এক্স পোস্টে রুবিও বলেন, “লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ বা অন্য যেকোনো জায়গায়, যারা আমেরিকানদের অধিকার হরণে সক্রিয়, তাদের প্রতি আর কোনো নীরবতা থাকবে না।”
তবে একই সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন এবং রুবিওর পররাষ্ট্র দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিদেশি শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশ নিয়েও কঠোর অবস্থান নিচ্ছে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। প্রশাসনের ভাষায়, এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইহুদি-বিরোধিতার বিরুদ্ধে অভিযান।
আইনি ভিত্তি ও বিতর্ক
একজন সাবেক পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা, যিনি ভিসা নিষেধাজ্ঞার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং গোপনীয়তার শর্তে কথা বলেন, বলেন রুবিও যে ধারার (adverse foreign policy consequence) উল্লেখ করেছেন তা অত্যন্ত বিস্তৃত। ফলে এ ঘোষণাটি আইনগত বাধা অতিক্রম করতে পারে।
তিনি বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রশাসন আসলে কোন বিষয়কে ‘বিদেশনীতি ক্ষতিসাধনকারী’ বলে মনে করে? ধরুন, কোনো আমেরিকান নাৎসি সমর্থক ফ্রান্সে কিছু পোস্ট করল, আর ফ্রান্স যদি নাৎসি প্রচারণা নিষিদ্ধ করে, তাহলে কি রুবিও বলবেন সেই ফরাসি প্ল্যাটফর্মের মালিক যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না?”
ইউরোপীয় প্রযুক্তি নীতির বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের সমালোচনা
এই পদক্ষেপ আসে ইউরোপীয় প্রযুক্তি নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল নেতাদের সমালোচনার প্রেক্ষিতে। হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জিম জর্ডান, ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স এবং মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গের মতো ব্যক্তিরা ইউরোপীয় আইন, যেমন ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট, নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জর্ডানের নেতৃত্বাধীন কমিটি রুবিওর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। এক্সে পোস্ট করে তারা লেখে, “দারুণ খবর! গত এক বছর ধরে আমরা বিদেশি সেন্সরশিপ চেষ্টার বিষয়টি উন্মোচন করেছি। এখন যারা মতপ্রকাশ বন্ধ করতে চায়, তাদের জবাবদিহি করতে হবে।”
জর্ডান কয়েক সপ্তাহ আগে ইউরোপীয় কমিশনের প্রযুক্তি সার্বভৌমত্ব বিষয়ক প্রধান হেনা ভার্ককুনেন-এর সঙ্গে ওয়াশিংটনে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
ইউরোপের প্রতিক্রিয়া ও নীরবতা
ইউরোপীয় নেতারা বারবার বলেছেন, তারা মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিকে টার্গেট করছেন না। ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র গিলিয়াম মার্সিয়ার বলেন, তারা রুবিওর ঘোষণার বিষয়ে অবগত, তবে এটিকে সাধারণ ধরনের উদ্যোগ মনে হচ্ছে। তাদের আর কোনো মন্তব্য নেই।
গুগল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি, এবং মেটা থেকেও সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ভিসা নিষেধাজ্ঞার অতীত ব্যবহার
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক মার্কিন প্রশাসন ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়িয়েছে। সাধারণত দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এসব নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হয় অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তানদের ওপরও, ফলে তা কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব ফেলে।
সাধারণত, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর স্পষ্ট করে জানায় না, কারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে। আংশিক কারণ হলো ভিসা সংক্রান্ত তথ্য গোপনীয়। তবে নাম প্রকাশ না করায় বিদেশে অনেকেই শঙ্কায় থাকেন, তারা টার্গেট হয়েছেন কি না এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ রাখতে হলে নিজ অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে কি না—এমন ভাবনা তাদের আচরণে প্রভাব ফেলে।