নাটকের নাম: রূপনগর
রচয়িতা: হুমায়ূন আহমেদ
পরিচালনা: মোস্তাফিজুর রহমান
প্রচারকাল: ঈদুল ফিতর, ১৯৮১, বাংলাদেশ টেলিভিশন
অভিনয়: আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, আবুল হায়াত, আলী যাকের
প্রধান চরিত্র: রাশেদ (আসাদুজ্জামান নূর)
নাটকের সারসংক্ষেপ ও বিষয়বস্তু
‘রূপনগর’ ঈদ উপলক্ষে নির্মিত একটি বিশেষ নাটক, যা ঢাকার রূপনগর এলাকায় বসবাসরত এক মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনসংগ্রামের গল্প বলে। রাশেদ, এই নাটকের মূল চরিত্র, একজন অফিসকর্মী। সে একা হাতে পুরো পরিবারের খরচ চালায়—মা-বাবা, বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে তার জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতা যেন এক অনবরত সংগ্রাম। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয় নাটকটি—প্রতি মুহূর্তে পরিবারের চাহিদা, সীমিত আয়ের টানাপোড়েন, সামাজিক তুলনা এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একত্রে গাঁথা হয়ে একটি অনন্য আবেগ সৃষ্টি করে।
রাশেদের জীবনে ঈদ মানে আনন্দের চেয়ে বেশি দায়িত্ব। ঈদের জামা কিনতে গিয়ে ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকানো, বোনের জন্য শাড়ি কিনতে গিয়ে দর কষাকষি, মায়ের ওষুধ কেনার টাকা জোগাড়—সব কিছুতেই তার ক্লান্তি, ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতা জড়িয়ে আছে। নাটকের একটি দৃশ্যে রাশেদ ছোট ভাইকে বলে, “এবারের পাঞ্জাবিটা একটু বড় করে সেলাই করতে বলেছি—তুই পরের ঈদেও পরতে পারবি।” এই একটি সংলাপেই ধরা পড়ে রাশেদের দারিদ্র্য আর তার ভালোবাসার গভীরতা।
অভিনয় ও চরিত্র বিশ্লেষণ
রাশেদ চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর অনবদ্য। তার মুখভঙ্গি, সংলাপ প্রক্ষেপণ, চোখের ভাষা—সবকিছু এতটাই সংযত ও জীবন্ত ছিল যে, দর্শকের কাছে চরিত্রটি হয়ে ওঠে একেবারে বাস্তব। আবেগপ্রবণ দৃশ্যগুলোতেও তিনি কোনো বাড়াবাড়ি না করে তার অভিনয়কে খুবই মাটির কাছাকাছি রেখেছেন।
সুবর্ণা মুস্তাফা রাশেদের প্রেমিকার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার সংলাপ কম, তবে তার অভিব্যক্তি এতটাই নিখুঁত যে এক-একটি মুহূর্তে তিনি পুরো দৃশ্যের ভার কাঁধে তুলে নেন। একটি সংলাপে তিনি বলেন, “তুমি শুধু অফিস আর সংসার বুঝো, আমি বুঝি তোমার সময় চাই।” এই সংলাপ আজও বহু দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে।
আবুল হায়াত এবং আলী যাকের দুটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেও নাটকের ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। আবুল হায়াত একজন হাস্যরসাত্মক প্রতিবেশীর চরিত্রে নাটকে স্বস্তির পরশ এনেছেন। অন্যদিকে আলী যাকের মামা হিসেবে রাশেদকে বাস্তবধর্মী পরামর্শ দিয়ে নাটকে একটি গভীর মাত্রা যোগ করেছেন।
নির্দেশনার গুণমান ও পরিবেশ নির্মাণ
মোস্তাফিজুর রহমান এই নাটকে কোনো বাড়তি নাটকীয়তা আনেননি। বরং সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে নীরবতা, হালকা আবহসঙ্গীত, ক্যামেরার ধীর গতি এবং দৈনন্দিন দৃশ্যাবলির নিখুঁত ব্যবহার নাটকটিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে। রান্নাঘরের হাঁড়ির শব্দ, জানালার পর্দা দুলে ওঠা, রিকশার ঘণ্টা কিংবা আজানের ধ্বনি—এসবই নাটককে বাস্তব অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে।
একটি বিশেষ দৃশ্য যেখানে রাশেদ খাওয়া শেষে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকায়—আর পেছনে আজানের মৃদু সুর বেজে ওঠে—এই মুহূর্তটিই নাটকের আবেগের চূড়ান্ত বিন্দু।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
‘রূপনগর’ শুধু একটি নাটক নয়, এটি ছিল হুমায়ূন আহমেদের নাট্যরচনার এক সূচনালগ্নের প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছেন, নাটকও জীবন হতে পারে—সাধারণ, সংবেদনশীল এবং নিঃশব্দে শক্তিশালী। মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন সংগ্রাম, যন্ত্রণার মধ্যে নিহিত ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ—এসব কিছু ‘রূপনগর’-এর মধ্য দিয়ে বারবার ধরা দেয়।
আজও ‘রূপনগর’ বাংলাদেশের টেলিভিশনের ঈদ নাটকের ইতিহাসে এক মাইলফলক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—উৎসব মানেই কেবল খুশি নয়, অনেকের জন্য তা দায়, দুঃখ আর ভালোবাসার এক গাঁথাও।