০৬:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পুঁজি সংকটে পড়বে বেসরকারি খাত, থমকে যাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান

সরকার ঋণ নেবে ব্যাংক থেকেবেসরকারি খাত থাকবে উপেক্ষিত

২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের কাছে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি ৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, সরকার আগামী অর্থবছরে আরও বেশি পরিমাণে রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভর করবে।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করেছেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। তাদের আশঙ্কা, ব্যাংকগুলো যখন সরকারের নিরাপদ বিনিয়োগে অর্থ আটকে ফেলবে, তখন বেসরকারি খাত—বিশেষ করে উৎপাদন, শিল্প ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলো পর্যাপ্ত ঋণ পাবে না। বিনিয়োগে স্থবিরতা আসবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, যা এক ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক সংকটকে ডেকে আনতে পারে।

২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, টানা সাত মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নিম্নগামী। ফেব্রুয়ারিতে এ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৬.৮২ শতাংশে—এটি ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন। যদিও মার্চে কিছুটা বেড়ে হয় ৭.৫৭ শতাংশ, তবুও তা উদ্বেগজনকভাবে নিচে রয়ে গেছে। অর্থাৎ, অর্থনীতির চালিকাশক্তি যে বেসরকারি খাত, তা ক্রমাগত বিনিয়োগ সংকোচনের মুখে পড়ছে।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ জানিয়েছেন, সরকারের অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ গ্রহণের কারণে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। এতে করে নতুন ব্যবসা চালু করা বা পুরনো ব্যবসার সম্প্রসারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বিদেশি ঋণ কমিয়ে ব্যাংকের ওপর চাপ

সরকার একদিকে বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে এনেছে (৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা আগের চেয়ে কম), অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ গ্রহণ কমাচ্ছে। ফলে ঘাটতি পূরণের প্রধান ভরসা হয়ে উঠছে ব্যাংক খাত। বাজেট ঘাটতির ৪৭ শতাংশ—২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা—তুলে নেয়া হবে ঋণ থেকে। এটি গতবারের ৪৪ শতাংশের তুলনায় বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের আর্থিক ভারসাম্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

বিজিএমইএর সতর্কতা: উৎপাদন ব্যয় বাড়বেবিনিয়োগে ভাটা

বিজিএমইএ’র অপেক্ষমাণ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলছেন, “ব্যাংকগুলো স্বাভাবিকভাবেই সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী, কারণ তা সবচেয়ে নিরাপদ। ফলে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, যা বিনিয়োগে ভাটা ফেলবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিকল্প উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।”

কর ব্যবস্থায় বৈষম্যব্যবসায়িক খরচ বাড়বে

ঢাকা চেম্বারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসায়-বান্ধব নয়। রোডম্যাপের অনুপস্থিতি, মধ্যবিত্তদের কর ছাড় না বাড়ানো, স্ল্যাব উঠিয়ে নেয়া, অটোমোবাইল খাতে খুচরা যন্ত্রাংশে শুল্ক বৃদ্ধি, টার্নওভার কর বাড়ানো, এবং মোবাইল শিল্পে ভ্যাট বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্তগুলো সরাসরি ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বাড়াবে।

বিশেষ করে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রযুক্তিনির্ভর এবং তরুণ উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক, সেসব খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অথচ এই খাতগুলোই কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

এসএমই খাত ও বিনিয়োগের জন্য নেই কোনো রোডম্যাপ

ঢাকা চেম্বারের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাজেটে এসএমই খাতের উন্নয়ন বা বিনিয়োগ সম্প্রসারণে কোনো কার্যকর রোডম্যাপ নেই। অথচ দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এই খাত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংক থেকে সরকারের অধিক হারে ঋণ গ্রহণের ফলে এসএমই খাত আরও ঋণবঞ্চিত হয়ে পড়বে।

মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব আদায়ে বাস্তবতা বিবর্জিত লক্ষ্য

তাসকীন আহমেদ আরও বলেন, বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একদিকে রাজস্ব চাপ, অন্যদিকে ব্যবসায় ব্যয় বৃদ্ধি—এ দুইয়ের সংমিশ্রণে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিলেও, এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

ঝুঁকির মুখে অর্থনীতি

এই বাজেট অর্থনৈতিক গতিশীলতা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের জন্য বিপজ্জনক সংকেত। সরকারের অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা একটি অদূরদর্শী পদক্ষেপ, যা দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, শিল্প, গার্মেন্টস খাত এবং চাকরির বাজারকে গভীর সংকটে ফেলতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের এই দিকগুলো পুনর্বিবেচনা করে বেসরকারি খাতে পুঁজির প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে, সামনের বছরগুলোতে অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার মুখোমুখি হতে পারে।

পুঁজি সংকটে পড়বে বেসরকারি খাত, থমকে যাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান

১১:১৪:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫

সরকার ঋণ নেবে ব্যাংক থেকেবেসরকারি খাত থাকবে উপেক্ষিত

২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের কাছে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি ৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, সরকার আগামী অর্থবছরে আরও বেশি পরিমাণে রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভর করবে।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করেছেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। তাদের আশঙ্কা, ব্যাংকগুলো যখন সরকারের নিরাপদ বিনিয়োগে অর্থ আটকে ফেলবে, তখন বেসরকারি খাত—বিশেষ করে উৎপাদন, শিল্প ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলো পর্যাপ্ত ঋণ পাবে না। বিনিয়োগে স্থবিরতা আসবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, যা এক ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক সংকটকে ডেকে আনতে পারে।

২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, টানা সাত মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নিম্নগামী। ফেব্রুয়ারিতে এ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৬.৮২ শতাংশে—এটি ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন। যদিও মার্চে কিছুটা বেড়ে হয় ৭.৫৭ শতাংশ, তবুও তা উদ্বেগজনকভাবে নিচে রয়ে গেছে। অর্থাৎ, অর্থনীতির চালিকাশক্তি যে বেসরকারি খাত, তা ক্রমাগত বিনিয়োগ সংকোচনের মুখে পড়ছে।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ জানিয়েছেন, সরকারের অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ গ্রহণের কারণে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। এতে করে নতুন ব্যবসা চালু করা বা পুরনো ব্যবসার সম্প্রসারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বিদেশি ঋণ কমিয়ে ব্যাংকের ওপর চাপ

সরকার একদিকে বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে এনেছে (৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা আগের চেয়ে কম), অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ গ্রহণ কমাচ্ছে। ফলে ঘাটতি পূরণের প্রধান ভরসা হয়ে উঠছে ব্যাংক খাত। বাজেট ঘাটতির ৪৭ শতাংশ—২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা—তুলে নেয়া হবে ঋণ থেকে। এটি গতবারের ৪৪ শতাংশের তুলনায় বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের আর্থিক ভারসাম্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

বিজিএমইএর সতর্কতা: উৎপাদন ব্যয় বাড়বেবিনিয়োগে ভাটা

বিজিএমইএ’র অপেক্ষমাণ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলছেন, “ব্যাংকগুলো স্বাভাবিকভাবেই সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী, কারণ তা সবচেয়ে নিরাপদ। ফলে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, যা বিনিয়োগে ভাটা ফেলবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিকল্প উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।”

কর ব্যবস্থায় বৈষম্যব্যবসায়িক খরচ বাড়বে

ঢাকা চেম্বারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসায়-বান্ধব নয়। রোডম্যাপের অনুপস্থিতি, মধ্যবিত্তদের কর ছাড় না বাড়ানো, স্ল্যাব উঠিয়ে নেয়া, অটোমোবাইল খাতে খুচরা যন্ত্রাংশে শুল্ক বৃদ্ধি, টার্নওভার কর বাড়ানো, এবং মোবাইল শিল্পে ভ্যাট বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্তগুলো সরাসরি ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বাড়াবে।

বিশেষ করে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রযুক্তিনির্ভর এবং তরুণ উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক, সেসব খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অথচ এই খাতগুলোই কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

এসএমই খাত ও বিনিয়োগের জন্য নেই কোনো রোডম্যাপ

ঢাকা চেম্বারের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাজেটে এসএমই খাতের উন্নয়ন বা বিনিয়োগ সম্প্রসারণে কোনো কার্যকর রোডম্যাপ নেই। অথচ দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এই খাত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংক থেকে সরকারের অধিক হারে ঋণ গ্রহণের ফলে এসএমই খাত আরও ঋণবঞ্চিত হয়ে পড়বে।

মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব আদায়ে বাস্তবতা বিবর্জিত লক্ষ্য

তাসকীন আহমেদ আরও বলেন, বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একদিকে রাজস্ব চাপ, অন্যদিকে ব্যবসায় ব্যয় বৃদ্ধি—এ দুইয়ের সংমিশ্রণে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিলেও, এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

ঝুঁকির মুখে অর্থনীতি

এই বাজেট অর্থনৈতিক গতিশীলতা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের জন্য বিপজ্জনক সংকেত। সরকারের অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা একটি অদূরদর্শী পদক্ষেপ, যা দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, শিল্প, গার্মেন্টস খাত এবং চাকরির বাজারকে গভীর সংকটে ফেলতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের এই দিকগুলো পুনর্বিবেচনা করে বেসরকারি খাতে পুঁজির প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে, সামনের বছরগুলোতে অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার মুখোমুখি হতে পারে।