আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে হামলার মাত্রা
এক বছর আগেও একরাতে ইউক্রেনের আকাশে ৩০টি ড্রোন হামলাকে ভয়াবহ বলে গণ্য করা হতো। এখন সেই সংখ্যা কয়েকশতে পৌঁছেছে। ২৫ মে রাতে রাশিয়া ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আকাশ হামলা চালায়—৩৫৫টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়, যা নতুন রেকর্ড। একইসাথে ছোড়া হয় অন্তত ৯টি ক্ষেপণাস্ত্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনা ব্যর্থ হয়—যা অত্যন্ত সম্ভাব্য—তাহলে ইউক্রেনকে বাধ্য হয়ে তার প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার সীমিত করতে হবে। এতে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আরও বেশি সংখ্যায় ইউক্রেনের শহর, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোতে আঘাত হানবে।
নতুন প্রজন্মের অস্ত্র দিয়ে বদলে যাচ্ছে রুশ কৌশল
২০২৫ সালের শুরু থেকেই রাশিয়ার আকাশ যুদ্ধ কৌশলে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। এখন বেশি ব্যবহার হচ্ছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইরান থেকে আনা নতুন প্রজন্মের ‘শাহেদ’ ড্রোন, যা আগের চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী।
এই ড্রোনগুলোর ষষ্ঠ সংস্করণে যুক্ত হয়েছে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি, যা কিয়েভের মতো উচ্চ-প্রতিরক্ষিত শহরেও আঘাত হানতে সক্ষম। ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার দিয়ে এগুলোকে বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে না, কারণ এগুলো জিপিএস নির্ভর নয় এবং ইউক্রেনের নিজস্ব মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চলতে পারে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর গতি এত বেশি যে, কেবল মার্কিন নির্মিত ‘প্যাট্রিয়ট পিএসি-৩’ ক্ষেপণাস্ত্রই কার্যকর প্রতিরক্ষা দিতে পারছে।
রাশিয়ার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে
গত বছর প্রতি মাসে ৩০০টির মতো শাহেদ ড্রোন তৈরি করত রাশিয়া। এখন সেই পরিমাণ তৈরি হচ্ছে মাত্র তিন দিনের মধ্যে। ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা বলছে, রাশিয়া দৈনিক ৫০০ ড্রোন উৎপাদনের পরিকল্পনা নিচ্ছে। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ একে অতিরঞ্জন মনে করছেন, তবুও ড্রোনের সংখ্যা যে দ্রুত বাড়ছে, তা নিশ্চিত।
এমনকি যদি ইউক্রেন পূর্ব ফ্রন্টে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে, তবুও আকাশ প্রতিরক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকবে।
আগে ছোট ক্যালিবারের বন্দুক ও মোবাইল টিম দিয়েই ড্রোন ধ্বংস করা হতো, কিন্তু এখন ড্রোনগুলো উচ্চতর উচ্চতায় পৌঁছে এসব প্রতিরক্ষার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে ইউক্রেন বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টার, এফ-১৬ ফাইটার জেট এবং ইন্টারসেপটর ড্রোন ব্যবহার করছে।
কিয়েভের চারপাশে ইউক্রেন প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন প্রায় ৯৫% ড্রোন ভূপাতিত করতে পারছে, তবুও বাকি ৫% প্রবেশ করে মারাত্মক ক্ষতি করছে।
‘প্যাট্রিয়ট’ ক্ষেপণাস্ত্রই ইউক্রেনের মূল ভরসা
ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার সক্ষমতা ইউক্রেনের আছে, কিন্তু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের পরিস্থিতি অনেক দুর্বল। এই মুহূর্তে বিশ্বে খুব কম দেশই এই ধরনের দ্রুতগতির অস্ত্র প্রতিহত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্যাট্রিয়ট’ সিস্টেম এখন কার্যত একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ইউক্রেনের হাতে এখন আটটি প্যাট্রিয়ট ব্যাটারি আছে, যদিও একসাথে সবগুলো সক্রিয় থাকে না। ২০২৩ সালের বসন্ত থেকে ইউক্রেন ১৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে।
তবে অধিকাংশ প্যাট্রিয়ট সিস্টেমই কিয়েভকেন্দ্রিক। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আরও অন্তত ১০টি ব্যাটারি ও বিপুল সংখ্যক পিএসি-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন প্রয়োজন হলে ইউরোপীয় অর্থায়নে এর খরচ বহন করতেও প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা এবং উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা
তবে মার্কিন প্রতিক্রিয়া অনিশ্চিত। বাইডেন প্রশাসনের অগ্রাধিকার তালিকা থেকে ইউক্রেন এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের চিন্তায় চীন মোকাবিলায় প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য ‘প্যাট্রিয়ট’ বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ।
প্যাট্রিয়ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন প্রতিবছর ৬৫০টি পিএসি-৩ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে, যেখানে রাশিয়া বছরে প্রায় ৭৫০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে গড়ে দুইটি পিএসি-৩ লাগে—এই অনুপাতে ইউক্রেন চরম ঘাটতির মুখে।
ইউক্রেন চাইছে নিজে পিএসি-৩ তৈরি করার অনুমতি, তবে সেটি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ইউরোপে কিছু যৌথ উৎপাদন প্রকল্প চলমান থাকলেও, কার্যকর হতে সময় লাগবে অন্তত এক বছর।
আকাশ প্রতিরক্ষা নয়, এবার পাল্টা আঘাতের দিকেই ঝুঁকতে হতে পারে
ফলে ইউক্রেনের সামনে হয়তো একটি বিকল্প কৌশলে যেতে হবে—আকাশ প্রতিরক্ষার পাশাপাশি হামলাকারী রুশ ঘাঁটি, ফ্যাক্টরি ও অস্ত্র মজুতস্থল ধ্বংস করার মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কোস্তিয়ান্তিন ক্রিভোলাপ বলেন, “আমরা যেন কোনো ভ্রান্তিতে না থাকি—এখন আমাদের আক্রমণ করতেই হবে।”