ক্রমবর্ধমান তাপদাহের কষাঘাত
ভারতে তাপমাত্রা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। গত বছর দেশের রেকর্ড করা ইতিহাসে সবচেয়ে গরম বছর ছিল; কোথাও কোথাও পারদ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়েছে। গত দেড় দশকে ১৫টি উষ্ণতম বছরের মধ্যে ১০টিই ঘটেছে এই সময়ে। এত তাপ শুধু গরম নয়—ইতিবাচক উৎপাদনশীলতা কমায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি মন্থর করে, মজুরি ও চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায়। দেশকে সমৃদ্ধ হতে হলে মানুষকে শীতল থাকার ব্যবস্থা করতেই হবে।
এয়ার কন্ডিশনারে ভরসা, কিন্তু ব্যয় সবার নাগালে নয়
প্রাণ বাঁচাতে এক শতাব্দী পুরোনো প্রযুক্তি—এয়ার কন্ডিশনারই—প্রধান আশ্রয়। যার সামর্থ্য আছে, সে কিনছে। ২০২৪ সালে বিক্রি পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়ে ১ কোটি ৪০ লাখে পৌঁছেছে; বহু নির্মাতার গুদাম ফাঁকা হয়ে গেছে। একটি বড় কোম্পানি চলতি বছর আরও ২০-২৫ শতাংশ বিক্রি বাড়ার আশা করছে। তবু ২০২৩ সালে দেশের মাত্র ১০ শতাংশ ঘরে এয়ার কন্ডিশনার ছিল—মূলত উচ্চ দাম ও সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ ভ্যাট-শুল্কের কারণে। সরকার সাদা পণ্যের উৎপাদনে প্রণোদনা দিয়ে দাম কমাতে ও কর্মসংস্থান বাড়াতে চেষ্টা করছে; তাতেও শিগগির চাহিদা আকাশছোঁয়া হবে।
বিদ্যুৎ চাহিদা ও জলবায়ুর দ্বৈত সংকট
বিপুল সংখ্যক নতুন শীতাতপ যন্ত্র মানে বিপুল বিদ্যুৎ প্রয়োজন। ২০২৪-এর মে মাসের এক গরম দুপুরে দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা ২৫০ গিগাওয়াট ছুঁয়েছে; এর প্রায় এক পঞ্চমাংশই আসে এয়ার কন্ডিশনার থেকে। বেশি বিদ্যুৎ মানে লোডশেডিংয়ের ঝুঁকি। উপরন্তু যন্ত্রগুলো বাইরের বাতাসে উষ্ণতা ছড়ায়, আর শীতলক হিসাবে ব্যবহৃত হাইড্রো-ফ্লুরো-কার্বন (এইচএফসি) গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে। সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
দামের রাশ টানতে নীতিগত সুযোগ
দরকার একসঙ্গে দু’দিক সামলানো—কম বিদ্যুৎখরচের যন্ত্র নিশ্চিত করা এবং যন্ত্রণাদায়ক গরমে সবার শীতে স্বস্তি পাওয়ার সুযোগ তৈরি করা। এখন বাজারে তিন-তারকা মানের যন্ত্র সবচেয়ে বেশি—বিক্রির ৬০ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু ভারতের বর্তমান মান এতই নিচু যে এসব যন্ত্র চীনে বিক্রি করার যোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করছেন: আজকের সবচেয়ে দক্ষ যন্ত্রগুলোকেই ন্যূনতম মান ধরা হোক; ২০৩০ ও ২০৩৩ সালে ধাপে ধাপে মান আরও বাড়ানো হোক। এতে তীব্র গরমের দিনে শীতাতপ যন্ত্রজনিত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎচাহিদা এক-তৃতীয়াংশ কমতে পারে।
দক্ষ প্রযুক্তি ও ‘প্যাসিভ কুলিং’—সমাধানের পথ
মান উন্নত হলেই দাম বাড়বে—এ ধারণা ভুল। বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, শক্তি-দক্ষতার মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, উৎপাদনশিল্পের স্কেল-ইকোনমির কারণে দাম বরং কমেছে। জাপানে ১৯৯০-২০১৫ সালে এয়ার কন্ডিশনারের দক্ষতা প্রায় দ্বিগুণ হলেও প্রকৃত মূল্য পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমেছে। একই পথ ভারতও নিতে পারে। এর পাশাপাশি বাড়ি-ঘর সাদা রং করা, ছাদে প্রতিফলক বসানো, যথেষ্ট ছায়া ও ক্রস-ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করা, এবং নতুন স্থাপনার নকশায় প্যাসিভ কুলিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করলে বিদ্যুৎচাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।
একই সঙ্গে শীতলতা ও সবুজ লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ
ভারত ইতিমধ্যে ২০৪৭ সালের মধ্যে এইচএফসি গ্যাসের ব্যবহার ৮৫ শতাংশ কমাতে বৈশ্বিক চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে—যদি উচ্চদক্ষতার মান বাধ্যতামূলক করা যায়, প্যাসিভ কুলিং ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং এইচএফসি দ্রুত কমানো যায়—তবে শীতাতপ খাতে নির্গত কার্বন ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। সরকার পুরোনো যন্ত্র বদলে উচ্চরেটেড যন্ত্র কিনতে উৎসাহ দিতে ‘বাই-ব্যাক’ স্কিম ও গণহারে সাশ্রয়ী দামে শক্তি-দক্ষ যন্ত্র কেনার মডেল ভাবছে। চ্যালেঞ্জ বড়, তবে সমাধানও হাতের কাছে। লক্ষ হলো: মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ঠান্ডা রাখতে হবে, আর পৃথিবীকে-কে বাঁচাতে উষ্ণতা সীমিত রাখতে হবে। উভয় লক্ষ্যেই দ্রুত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।