০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

গাধাই এখন পাকিস্তানে সব থেকে দামী

আফ্রিকান ইউনিয়ন ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাধার চামড়া বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর চীনের প্রধান সরবরাহকারী হয়ে ওঠে পাকিস্তান। এতে গাধার দামে হঠাৎ উত্থান, শ্রমজীবী বহু পরিবার ও প্রাণীকল্যাণ—সবই গভীর সংকটে পড়ে।

জীবিকার শেষ সম্বল

৫০ বছর বয়সী গুলজার ও তাঁর ১৪ সদস্যের পরিবারের আয়ের দড়ি বাঁধা মাত্র একটি গাধার সঙ্গে—যে প্রতিদিন ১,৩৫০ কেজি লোহার বোঝা টেনে করাচির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দেয়। দৈনিক আয় ১,২০০-১,৬০০ রুপি; অর্ধেকই চলে যায় গাধার খাবার আর চিকিৎসায়। দাম বাড়া আর উচ্চ মৃত্যুহারের কারণে নতুন গাধা কেনাও এখন ঝুঁকির।

বাড়ছে সংখ্যা, দ্বিগুণ হচ্ছে দাম

সরকারি হিসেবে পাকিস্তানে কর্মরত গাধার সংখ্যা ৫.৯ মিলিয়ন; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থির বৃদ্ধির ধারা বজায় আছে। তবু করাচির লিয়ারির বড় বাজারে একটি ভালো গাধার দাম ৩ লাখ রুপি ছুঁয়েছে—দাম বাড়ার প্রধান কারণ চীনা ইজিয়াও শিল্পের তীব্র চাহিদা।

ইজিয়াও কী এবং কেন দরকার?

শানদং প্রদেশের ত্রিহাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ইজিয়াও—গাধার চামড়া সেদ্ধ করে তৈরি জেলাটিন—রক্তস্বল্পতা, ক্লান্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির দাওয়াই হিসেবে চীনের মধ্যবিত্তের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়। ২০১৬-এর পর উৎপাদন ১৬০ শতাংশ বেড়েছে; চীনের নিজস্ব গাধার সংখ্যা ১৯৯০-এর ৫.৬ মিলিয়ন থেকে ২০২২-এ মাত্র ৮.৬ লাখে নেমে আসে, ফলে বিদেশি চামড়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ে।

আফ্রিকা থেকে পাকিস্তান—যোগানের স্রোত বদল

আফ্রিকার অনেক দেশ গাধা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করার পর ২০২৩-এ চীন মোট ১৩.৩ লাখ গাধা ও গরুর চামড়া আমদানি করে; এর মধ্যে পাকিস্তান সরবরাহ করে ১.৫৭ লাখ, যা ২০২৪-এ আরও বেড়ে শীর্ষ স্থানে ওঠে।

চীনা খামারের প্রস্তাব ও সরকারি শর্ত

২০২৫-এর এপ্রিলেই চীনা প্রতিনিধি দল পাকিস্তানে গাধা খামার গড়ার আগ্রহ জানায়। খাদ্য নিরাপত্তা মন্ত্রী রানা তানভীর হুসেইন স্বাগত জানালেও স্থানীয় গাধার সুরক্ষা নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দেন। এর আগে খাইবার পাখতুনখোয়ায় বেসরকারিভাবে প্রস্তাব উঠে হলেও সরকারি সম্মতি না মেলায় এগোয়নি।

নীতি, নিষেধাজ্ঞা ও আইনগত ফাঁক

২০১৫-তে অর্থনৈতিক সমন্বয় পরিষদ অস্থায়ীভাবে গাধা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করলেও পরে চামড়া-মাংস সম্পূর্ণ রপ্তানির শর্তে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বিদ্যমান প্রাণী নির্যাতন আইনের জরিমানা মাত্র ৫০-১০০ রুপি—প্রাণীকল্যাণ রক্ষায় কার্যত অকার্যকর।

৩৬ মিলিয়ন জীবিকা ঝুঁকিতে

ইটভাটা, কৃষি, আবর্জনা সংগ্রহ, নির্মাণ ও নগর পরিবহনে গাধার অবদান অপরিসীম। গন্ধরা প্রতিদিন গড়ে ১,০০০ কেজি অবর্জনা ও ১০০ কেজি পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান টেনে আনে। দাম দ্বিগুণ হওয়ায় ছোট আকারের গাধা কিনতেও এখন ৩০-৪০ হাজার রুপি লাগে।

বাজারে চীনা ক্রেতা

করাচির লিয়ারি ও ভেড়া কলোনি বাজারে চীনা ক্রেতারা অসুস্থ গাধাও কিনছেন ২,০০০ রুপি কিংবা তারও কমে। স্থানীয় বিক্রেতাদের কেউ কেউ স্বাস্থ্যহীন গাধা বিক্রি করলেও অনেক মালিক নৈতিক কারণে সম্মত নন।

সংস্কৃতি ও ‘সেলিব্রিটি’ গাধা

শহরের ঐতিহ্যবাহী গাধা-গাড়ি দৌড় প্রতি রবিবার ২-আড়াই হাজার দর্শক টানে। দ্রুতগামী ‘দাম্পার’, ‘জলেবি’ বা ‘নয়া দৌর’–এর মতো গাধার জন্য মালিকেরা বাদাম-দুধের বিশেষ খাবার দিয়ে প্রতিদিন ৮০০-১,২০০ রুপি খরচ করেন; ৩ লাখ রুপির প্রস্তাব ফিরিয়েও দেন।

নৈতিকতা ও টেকসইতা

গাধা ধীরে বংশবৃদ্ধি করে—গর্ভধারণ ১২ মাস, সাধারণত এক বাচ্চা। দ্রুত চাহিদা মেটাতে প্রজননব্যবস্থা না গড়ে উঠলে গরিব পরিবারগুলোর কাছ থেকে গাধা কেড়ে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। পশুর প্রতি মানবিক দায়বদ্ধতা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ভারসাম্য, দুটিই প্রশ্নের মুখে।

বিকল্প পথ

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সচেতনতা বাড়ানো, সরকারি নিষেধাজ্ঞা, এমনকি ল্যাব-উৎপাদিত কোলাজেনের মতো প্রযুক্তিগত বিকল্পের কথা বলছে। তবে ইজিয়াও চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে এতটাই জড়িত যে, একে বদলানো সহজ হবে না।

উপসংহার

অলস কোনো ‘‘বোঝার পশু’’ নয়—পাকিস্তানের গাধা কোটি মানুষের রুটি-রুজি, সংস্কৃতি ও সহচর। চীনের ক্রমবর্ধমান ইজিয়াও চাহিদা তাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। টেকসই পরিকল্পনা, শক্তিশালী আইন এবং নৈতিক বোধ না থাকলে এই ‘‘শক্ত সেতু’’ ভেঙে পড়তে পারে, যার ধাক্কা বহন করতে হবে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোকে।

গাধাই এখন পাকিস্তানে সব থেকে দামী

০৮:৫২:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

আফ্রিকান ইউনিয়ন ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাধার চামড়া বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর চীনের প্রধান সরবরাহকারী হয়ে ওঠে পাকিস্তান। এতে গাধার দামে হঠাৎ উত্থান, শ্রমজীবী বহু পরিবার ও প্রাণীকল্যাণ—সবই গভীর সংকটে পড়ে।

জীবিকার শেষ সম্বল

৫০ বছর বয়সী গুলজার ও তাঁর ১৪ সদস্যের পরিবারের আয়ের দড়ি বাঁধা মাত্র একটি গাধার সঙ্গে—যে প্রতিদিন ১,৩৫০ কেজি লোহার বোঝা টেনে করাচির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দেয়। দৈনিক আয় ১,২০০-১,৬০০ রুপি; অর্ধেকই চলে যায় গাধার খাবার আর চিকিৎসায়। দাম বাড়া আর উচ্চ মৃত্যুহারের কারণে নতুন গাধা কেনাও এখন ঝুঁকির।

বাড়ছে সংখ্যা, দ্বিগুণ হচ্ছে দাম

সরকারি হিসেবে পাকিস্তানে কর্মরত গাধার সংখ্যা ৫.৯ মিলিয়ন; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থির বৃদ্ধির ধারা বজায় আছে। তবু করাচির লিয়ারির বড় বাজারে একটি ভালো গাধার দাম ৩ লাখ রুপি ছুঁয়েছে—দাম বাড়ার প্রধান কারণ চীনা ইজিয়াও শিল্পের তীব্র চাহিদা।

ইজিয়াও কী এবং কেন দরকার?

শানদং প্রদেশের ত্রিহাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ইজিয়াও—গাধার চামড়া সেদ্ধ করে তৈরি জেলাটিন—রক্তস্বল্পতা, ক্লান্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির দাওয়াই হিসেবে চীনের মধ্যবিত্তের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়। ২০১৬-এর পর উৎপাদন ১৬০ শতাংশ বেড়েছে; চীনের নিজস্ব গাধার সংখ্যা ১৯৯০-এর ৫.৬ মিলিয়ন থেকে ২০২২-এ মাত্র ৮.৬ লাখে নেমে আসে, ফলে বিদেশি চামড়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ে।

আফ্রিকা থেকে পাকিস্তান—যোগানের স্রোত বদল

আফ্রিকার অনেক দেশ গাধা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করার পর ২০২৩-এ চীন মোট ১৩.৩ লাখ গাধা ও গরুর চামড়া আমদানি করে; এর মধ্যে পাকিস্তান সরবরাহ করে ১.৫৭ লাখ, যা ২০২৪-এ আরও বেড়ে শীর্ষ স্থানে ওঠে।

চীনা খামারের প্রস্তাব ও সরকারি শর্ত

২০২৫-এর এপ্রিলেই চীনা প্রতিনিধি দল পাকিস্তানে গাধা খামার গড়ার আগ্রহ জানায়। খাদ্য নিরাপত্তা মন্ত্রী রানা তানভীর হুসেইন স্বাগত জানালেও স্থানীয় গাধার সুরক্ষা নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দেন। এর আগে খাইবার পাখতুনখোয়ায় বেসরকারিভাবে প্রস্তাব উঠে হলেও সরকারি সম্মতি না মেলায় এগোয়নি।

নীতি, নিষেধাজ্ঞা ও আইনগত ফাঁক

২০১৫-তে অর্থনৈতিক সমন্বয় পরিষদ অস্থায়ীভাবে গাধা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করলেও পরে চামড়া-মাংস সম্পূর্ণ রপ্তানির শর্তে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বিদ্যমান প্রাণী নির্যাতন আইনের জরিমানা মাত্র ৫০-১০০ রুপি—প্রাণীকল্যাণ রক্ষায় কার্যত অকার্যকর।

৩৬ মিলিয়ন জীবিকা ঝুঁকিতে

ইটভাটা, কৃষি, আবর্জনা সংগ্রহ, নির্মাণ ও নগর পরিবহনে গাধার অবদান অপরিসীম। গন্ধরা প্রতিদিন গড়ে ১,০০০ কেজি অবর্জনা ও ১০০ কেজি পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান টেনে আনে। দাম দ্বিগুণ হওয়ায় ছোট আকারের গাধা কিনতেও এখন ৩০-৪০ হাজার রুপি লাগে।

বাজারে চীনা ক্রেতা

করাচির লিয়ারি ও ভেড়া কলোনি বাজারে চীনা ক্রেতারা অসুস্থ গাধাও কিনছেন ২,০০০ রুপি কিংবা তারও কমে। স্থানীয় বিক্রেতাদের কেউ কেউ স্বাস্থ্যহীন গাধা বিক্রি করলেও অনেক মালিক নৈতিক কারণে সম্মত নন।

সংস্কৃতি ও ‘সেলিব্রিটি’ গাধা

শহরের ঐতিহ্যবাহী গাধা-গাড়ি দৌড় প্রতি রবিবার ২-আড়াই হাজার দর্শক টানে। দ্রুতগামী ‘দাম্পার’, ‘জলেবি’ বা ‘নয়া দৌর’–এর মতো গাধার জন্য মালিকেরা বাদাম-দুধের বিশেষ খাবার দিয়ে প্রতিদিন ৮০০-১,২০০ রুপি খরচ করেন; ৩ লাখ রুপির প্রস্তাব ফিরিয়েও দেন।

নৈতিকতা ও টেকসইতা

গাধা ধীরে বংশবৃদ্ধি করে—গর্ভধারণ ১২ মাস, সাধারণত এক বাচ্চা। দ্রুত চাহিদা মেটাতে প্রজননব্যবস্থা না গড়ে উঠলে গরিব পরিবারগুলোর কাছ থেকে গাধা কেড়ে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। পশুর প্রতি মানবিক দায়বদ্ধতা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ভারসাম্য, দুটিই প্রশ্নের মুখে।

বিকল্প পথ

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সচেতনতা বাড়ানো, সরকারি নিষেধাজ্ঞা, এমনকি ল্যাব-উৎপাদিত কোলাজেনের মতো প্রযুক্তিগত বিকল্পের কথা বলছে। তবে ইজিয়াও চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে এতটাই জড়িত যে, একে বদলানো সহজ হবে না।

উপসংহার

অলস কোনো ‘‘বোঝার পশু’’ নয়—পাকিস্তানের গাধা কোটি মানুষের রুটি-রুজি, সংস্কৃতি ও সহচর। চীনের ক্রমবর্ধমান ইজিয়াও চাহিদা তাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। টেকসই পরিকল্পনা, শক্তিশালী আইন এবং নৈতিক বোধ না থাকলে এই ‘‘শক্ত সেতু’’ ভেঙে পড়তে পারে, যার ধাক্কা বহন করতে হবে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোকে।