বাজার পরিস্থিতি: রাজধানী ও বিভাগীয় শহর
ঈদুল আজহার এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে রাজশাহীর সাহেববাজার পর্যন্ত ঘুরে দেখলে দেখা যায়, মশলার দাম কোথাও স্থিতিশীল, কোথাও আবার ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানীতে দারুচিনি প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকা, এলাচ ৪,৪০০-৬,০০০ টাকা, লবঙ্গ ১,৩০০-১,৬০০ টাকা এবং জিরা ৬০০-৯০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে রাজশাহীতে একই সময়ে এলাচের দাম ৪,৮০০ টাকা, জিরা ৬০০-৭০০ টাকা এবং রসুন ১৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যা এক মাসে কেজিতে ৩০-৫০ টাকা বৃদ্ধি নির্দেশ করে। ফলে জাতীয় পর্যায়ে গড় দাম কিছুটা কমলেও আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।
মূল্যতালিকা: কোন মশলা কত
কারওয়ান বাজার ও টিসিবি (Trading Corporation of Bangladesh)-র সাম্প্রতিক তথ্য মেলালে দেখা যায়, বছরের ব্যবধানে শুকনো মরিচে ২৬ শতাংশ, জিরায় ১৪ শতাংশ এবং দারুচিনিতে ৪ শতাংশ মূল্যপতন ঘটেছে; তবে এলাচের দামে ৩১ শতাংশ উল্লম্ফন রয়ে গেছে। খুচরা বাজারে ২০০ গ্রাম এলাচ কিনতে এখন ১,২৫০-১,৫০০ টাকা গুনতে হচ্ছে; রান্নার ঘন ব্যবহারিক জিরার আধা কেজি ৩৭৫-৪৫০ টাকা, দারুচিনি ২৭৫-৩০০ টাকা ও ২০০ গ্রাম লবঙ্গ ২৮০-৩২০ টাকা। মাত্র চারটি মশলার এই ক্ষুদ্র ‘ঈদ-ঝুড়ি’-র ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২২-২৩শ’ টাকা, যা নিম্ন আয়ের একজন চাকরিজীবীর পাঁচ দিনের মজুরি (দৈনিক ৪৫০-৫০০ টাকা) বা একজন রিকশাচালকের সপ্তাহখানেকের আয়।
গত ঈদের তুলনা: থাকছে না এলাচের গন্ধ
২০২৪-এর ঈদুল আজহার আগে একই এলাচ বিক্রি হয়েছিল ৩,৫০০-৪,৩০০ টাকায়, দারুচিনি ৬৫০-৭০০, লবঙ্গ ১,৬০০-১,৮০০ আর বে-পাতা ২০০-৩০০ টাকায়। তুলনামূলকভাবে চলতি বছর কিছু মশলায় ৫-১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতির ধারা দেখা গেলেও এলাচ-নির্ভর খাসির কোরমা কিংবা বিরিয়ানি-র স্বাদে যে ‘বড় এলাচ’ অপরিহার্য, তার দাম বিধ্বংসী গতিতে বাড়ায় সামগ্রিক খরচের গ্রাফ নিচে নামছেই না। শুধু রাজধানী নয়, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরেও এলাচ-কেন্দ্রিক এই খরচ-চাপ স্পষ্ট।
কেন এই দাম বাড়া-কমা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, পর্যাপ্ত আমদানি থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা বাড়াচ্ছে; উচ্চ শুল্ক, ডলারদর বৃদ্ধি ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধজনিত জাহাজভাড়া-বৃদ্ধিও খরচ বাড়ার বড় কারণ। এলাচ-দারুচিনি-লবঙ্গ-জিরার মতো ৮০ শতাংশ আমদানি নির্ভর মশলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের দোলাচল সরাসরি ঘরোয়া বাজারে কাঁপন তোলে। আবার চালান চুক্তি (forward booking) কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ‘শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা’ করে, যার অধিক ব্যয় ভোক্তার কাঁধে চাপছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য
কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা আবদুল কাদের বলেন, ‘শুল্ক বিল পরিশোধে ব্যাংক-জটিলতা ও বাড়তি ডলারের চাপ মিশে পাইকারি দামে খানিকটা ওঠানামা হচ্ছে, খুচরায় তার প্রতিফলন একটু বাড়তি’। বিপরীতে রাজশাহীর খুচরা বিক্রেতা সোহেল মিয়া যুক্তি দেন, ‘আগের বেশি দামে কেনা মাল এখনও বিক্রি হচ্ছে, তাই লাভ মার্জিন ঠিক রেখে দাম কমানো যাচ্ছে না’। দু’পক্ষের বক্তব্যেই কাঠগড়ায় উঠেছে বাজার-মনিটরিং এবং সময়মত পাইকারি দাম কম খুচরা বাজারে প্রতিফলনের ঘাটতি।
নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের অবস্থা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের গড় মাসিক ব্যয় ২২–২৫ হাজার টাকা; এর ৬–৭ শতাংশ মশলা-তৈল-লবণসহ কন্ডিমেন্ট খাতে। একক ভাবে এলাচ-জিরা-লবঙ্গের দফায় দফায় দাম বাড়ায় এই খাতের ভাগ ১০ শতাংশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। নগরীর গার্মেন্ট শ্রমিক রেশমা আক্তারের ভাষ্য, ‘বছরের বড় কোরবানির রান্নায় এলাচ-দারুচিনি না দিলে স্বাদ হয় না। কিন্তু আধা কেজি মশলায় যে টাকা লাগে, তা দিয়ে তিন কেজি গরুর মাংস কেনা যায়’। মধ্য আয়ের ব্যাংককর্মী হাসিবুর রহমানের হিসাবে, ২০২৪-এ ঈদ রান্নায় মশলা-ঝুড়ি কিনতে যেখানে ১,৮০০ টাকার মতো লেগেছিল, এবার তা ২,২০০-এর ওপরে—অর্থাৎ ২৫ শতাংশ বেশি। ফলে আয়-ব্যয়ের সমীকরণে এক ধরনের ‘অদৃশ্য কর’ যোগ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মন্তব্য
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বাবুল হোসেন মনে করেন, ‘মশলার বাজারে সিন্ডিকেট-নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ। যখনই উৎসব আসে, বাজার-গোছানো নামে কিছু হাত গরম হয়।’ তার পরামর্শ, এলাচ-দারুচিনির উচ্চ শুল্ক সাময়িকভাবে কমিয়ে ভোক্তা-মুখী দাম সহনীয় রাখতে হবে; পাশাপাশি স্থানীয় আদা-রসুন-মরিচ উৎপাদনে প্রণোদনা দিয়ে আমদানি-নির্ভরতা হ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি অর্থনীতিবিদ রশিদুল হাসান বলেন, ‘প্যাকেজিং-জাতীয় যুক্তি দেখিয়ে ৪০-৫০ শতাংশ অবধি খুচরা মার্জিন নেওয়া হচ্ছে, যা অযৌক্তিক; সরকার যদি পাইকারি-খুচরা সর্বোচ্চ মূল্য-সীমা নির্ধারণ করে, তাহলে ভোক্তা-স্বস্তি ফিরবে’।