ঢাকার অদূরে গাবতলী হাট থেকে শুরু করে জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত, এবারের ঈদুল আজহায় সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল—মাংসের ভাগাভাগি। মূল্যস্ফীতি, কর্মসংকট ও ঋণের চাপে নুইয়ে পড়া হাজারো পরিবার বছরের পর বছর গরুর মাংসের স্বাদ ভুলে গিয়েছিল। এবারের উৎসবে, দীর্ঘদিন পরে হলেও, সেই স্বাদ আবার ফিরেছিল তাদের দাওয়াতে। কৌটোর মুখ খুলতেই টিনের ঘরে ভেসে ওঠা ঝাল-মাংসের ঘ্রাণ শুধু পেট নয়, মনও ভরিয়ে দিয়েছিল।
বঞ্চনার দিনগুলো
করাইল বস্তির শিশু রিজভী পড়াশোনায় ভালো হলেও পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল। মা মুক্তা বেগম বললেন, “ছয় মাস হলো ছেলের পাতে শুধু ডাল-ভাত। একটু ডিম দিলেও মনে হতো রাজকীয় খাবার খাওয়াচ্ছি।” সরকারিভাবে নির্ধারিত জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দৈনিক আয়ের বেশির ভাগটাই ভাড়াতেই খরচ হয়ে যাচ্ছিল। বাজারে এক কেজি গরুর মাংস ৭৫০ টাকা ছুঁলেই সেই পরিবারের পক্ষে তা কেনা রীতিমতো স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ঈদের আগমন ও স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারে-দ্বারে করুণ আকুতি
ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোরবানি ভাগের জন্য মানুষের সারি লেগে গিয়েছিল। সময় পেলেই মুক্তা বেগম লাইনে দাঁড়াতেন, কারণ এটাই ছিল ছেলের মুখে মাংস তুলে দেওয়ার একমাত্র সুযোগ। দ্য ডেইলি স্টার-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোরবানির দিন ভোর থেকেই সামর্থ্যবানদের বাড়ির সামনে ‘এক টুকরো মাংসের’ আশায় দীর্ঘ লাইন গড়ে ওঠে; পশু কম, প্রার্থী বেশি, ফলে অনেকে আবার খালি হাতে ফিরে যান।
গোশতের ঘ্রাণে ফিরোজা আপার চোখ ভেজা
মিরপুরের শেওড়াপাড়া বস্তির ফিরোজা আপার গল্পটা আরও বেদনাময়। তিনি পোশাক কারখানায় কাজ হারিয়েছেন, সন্তান দুটির খরচ সামলানোই কষ্ট। ঈদের দিন দুপুরের আগে পর্যন্তই চুলায় ভাত চড়েনি। হঠাৎ একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক এসে ২ কেজি গোশত দিয়ে গেল। “চুলার পাশে দাঁড়িয়ে আমি কাঁদছিলাম,” তিনি বললেন। “শেষ কবে বাচ্চাদের গরুর মাংস খাইয়েছি মনে নেই।”
চিত্র বদলাল সহমর্মিতায়
ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ জানিয়েছে, ২০২৫-এর কোরবানিতে তারা দেশের ৩০টি জেলায় ৬৫ হাজার পরিবারে মাংস পৌঁছে দিয়েছে। পাশাপাশি ওভিজাত্রিক, স্পারবিডি ও অন্যান্য বেসরকারি সংগঠন নগদ অনুদান ও ‘কিউ-কার্ড’ পদ্ধতিতে সুবিধাভোগী বাছাই করে মাংসের প্যাকেট দিচ্ছে।
শিশুদের হাসি আর কাঁধে-কাঁধে রান্না
গরুর বুকের রসালো মাংসের ঝোলে কচি আলু আর পাকা মরিচ ফুটতে-ফুটতে যে আনন্দটা মায়েরা ভাগ করে নিয়েছেন, তা শুধু খাবারের উৎসব নয়—মনেরও উৎসব। ১২ বছরের রিজভী প্রথম বার ঢাকায় এসে শুনেছিল, ঈদে নাকি পেটপুরে মাংস পাওয়া যায়। সেদিন দুপুরে প্লেটে গোশত দেখে রিজভীর চোখ চকচক করছিল। “মা, আজ কি দুপুরে ঘুমাব?”—তার প্রশ্নে মুক্তা হেসে বলেছিলেন, “না রে বাবা, খেয়ে আজ ছাদে গিয়ে আকাশ দেখবি!”
অপারস্পরিক বৈষম্যের সেতু
তথ্য বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করায় নিম্নমধ্যবিত্তরাও চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তা-ছাড়া গরুর গড় দাম গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে মাংসের বোতলজাত খাবার কিংবা খাসির সিঙ্গারা ছিল অলীক স্বপ্ন। কিন্তু খেটে-খাওয়া মানুষের সেই স্বপ্ন এই ঈদে খানিকটা হলেও সত্যি হলো।
এক সঙ্গে খাওয়া, অনেক গল্প
ওয়ারীর ৬২ নম্বর গলিতে চারটি পরিবার মিলে একটি পাতিলে রান্না করেছিল কোরমা—কারও কাছে এল ৫০০ গ্রাম, কারও কাছে ৩৫০ গ্রাম, কেউ আবার শুধু হাড় পেলেও খুশি ছিল। সন্ধ্যায় সবাই একসঙ্গে খেতে বসে যার যা ছিল, তা ভাগ করে নিয়েছে। ফাতেমা বেগম বললেন, “মাংসের পরিমাণ দেখলে মনে হয় না, এটা ভাগ করে খাওয়ার মতো। কিন্তু আনন্দটাই বড়।”
স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিক
পুষ্টিবিদদের মতে নিয়মিত প্রোটিনের অভাব শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক জানান, “ঈদের সময় যেসব পরিবার মাংস পাওয়ার সুযোগ পায়, তাদের শরীরে অন্তত মাস দুয়েকের জন্য প্রোটিনের ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে যায়।” ফলে এই মাংস শুধু এক দিনের উৎসব নয়, দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টির সঞ্চয়ও বটে।
অনুভূতির রেশ
ঈদুল আজহার এই মাংস শুধু খাদ্যসামগ্রী ছিল না; ছিল বেঁচে থাকার শক্তি, মানবিক বন্ধন আর সামাজিক সমতার সোপান। এক টুকরো গোশত কারও চোখে আনন্দের পানি এনে দিয়েছিল, কারও মুখে ফিরিয়ে দিয়েছিল দীর্ঘ উৎকণ্ঠার পর খাওয়ার হাসি।
দিনশেষে, সেসব মানুষ আবারও স্বাদ পেল মাংসের; হয়তো সামান্য, তবু তাতে ছিল স্বপ্নের ওজন, সম্মিলিত ভালোবাসার ঘ্রাণ। ঈদের সেই দুপুরে তারা বুঝেছে—ভাগ করে খেলে, হাসি-কান্না মিলিয়ে রাখলে, অভাবকেও ঠেকিয়ে রাখা যায়। সামনের দিনগুলোতে হয়তো অভাবের কষ্ট আবার উঁকি দেবে, তবু এই ঈদে প্রাপ্ত এক থালা মাংস তাদের মনে বুনেছে বেঁচে থাকার নতুন গল্প, নতুন সাহস।