ছুটির শহরে এক অন্য অভিজ্ঞতা
ঈদের ছুটির সময় ঢাকাকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। কোটি মানুষের কোলাহল, যানজট আর ধোঁয়ায় মোড়ানো নগরী যেন আচমকা বদলে যায় এক স্বস্তিদায়ক, শ্বাসপ্রশ্বাসের উপযোগী শহরে। এই বিরল মুহূর্তকে উপভোগ করতেই দুই পুরনো বন্ধু—রাফি ও সাদ—যাত্রা করেছিলেন ঢাকায় এক দিনের ভ্রমণে। রাজধানীর চেনা অলিগলি, ঐতিহাসিক স্থান, পার্ক ও রাস্তার মোড়গুলো যেন নতুন করে ধরা দেয় তাদের চোখে। এই প্রতিবেদন সেই একদিনের অভিজ্ঞতার খতিয়ান।
উত্তরা থেকে শুরু
ঈদের তৃতীয় দিন, সকাল ৭টা। উত্তরা সেক্টর ১১-এর এক ছোট্ট চায়ের দোকানে দেখা হলো রাফি ও সাদের। দীর্ঘদিন পরে একসাথে ঈদের ছুটি কাটানোর সুযোগ এসেছে। দুইজনেই ছাত্রজীবন শেষ করে এখন কর্মজীবনে ব্যস্ত। ঢাকায় থাকলেও প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা ও যানজটে দেখা করার অবকাশ মেলে না। কিন্তু আজকের ঢাকা আলাদা—শূন্য রাস্তায় ঠান্ডা বাতাস আর স্নিগ্ধ সূর্য। তারা ঠিক করলেন, গাড়ি নয়, সিএনজি নয়, পুরোটা দিন ঘোরাঘুরি করবেন মোটরবাইকে। রাফির পুরনো বাইকই হবে তাদের সঙ্গী।
প্রথম গন্তব্য—ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর। রাস্তা একদম ফাঁকা। উত্তরা থেকে ফার্মগেট পেরিয়ে ধানমন্ডি পৌঁছাতে সময় লাগল মাত্র ২৫ মিনিট, যা সাধারণ দিনে এক ঘণ্টারও বেশি।
রবীন্দ্র সরোবরে নীরবতা
সকাল সকাল সরোবরে হাঁটতে এসেছেন দু-একজন। পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ আর জলছোঁয়ার মৃদু ধ্বনি যেন ঢাকার এক গোপন রূপ উন্মোচন করে। রাফি বলল, “এটা কি সত্যিই ঢাকা? কোনো শব্দ নেই, কোনো হর্ন নেই, কেবল প্রকৃতি!”
তারা হাঁটলেন, পুরনো নাট্যমঞ্চের পাশে গিয়ে বসলেন, ছবি তুললেন। সাদ তার ক্যামেরা বের করল। সারা বছরের ক্লান্তি ভুলে যেন শিশুর মতো আনন্দে ভরে উঠল দুই বন্ধুর চোখ।
কার্জন হল ও পুরান ঢাকা
এরপর তারা রওনা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। টিএসসি, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, চারুকলা ভবনের দেয়ালচিত্র—সবকিছুই আজ যেন থেমে গেছে। ছাত্র নেই, মিছিল নেই, স্লোগান নেই—তবুও একধরনের স্মৃতির আবরণ যেন ভেসে উঠছে চোখে।
বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে গেলেন কার্জন হলের দিকে। ঐতিহাসিক এই ভবনের সামনে কিছু বিদেশি পর্যটক ছবি তুলছিলেন। সাদ মুখ টিপে হাসল, “আজ আমরা নিজের শহরের পর্যটক।”
তারপর রওনা দিলেন পুরান ঢাকার পথে। বংশাল, লালবাগ, চকবাজার—সবই যেন এক অন্য রঙে রাঙানো। গাড়ির হর্ন নেই, মানুষ কম, দোকানগুলো অর্ধেক বন্ধ। তারা পৌঁছালেন লালবাগ কেল্লায়। ছুটির কারণে দর্শনার্থী কিছু থাকলেও ভিড় ছিল সহনীয়।
চকবাজারে বিরিয়ানি, আর পুরনো স্বাদ
ভ্রমণ এতক্ষণে খিদের জায়গা করে নিয়েছে। তারা রওনা হলেন চকবাজারের দিকে। বিখ্যাত হাজীর বিরিয়ানির দোকান খোলা ছিল। ধোঁয়া উঠতে থাকা বিরিয়ানির থালা, লেবু ও পেঁয়াজ দিয়ে পরিবেশন, আর ঠান্ডা একটি কোক—এই একসাথে যেন পুরান ঢাকার পূর্ণতা পেল দুই বন্ধু।
খাওয়া শেষে হাঁটতে হাঁটতে তারা রওনা দিলেন আরেক গন্তব্যের দিকে—সূর্যসেন পার্ক।
সূর্যসেন পার্কে বিশ্রাম
সেখানে বসে তারা স্মৃতিচারণ করলেন কলেজ জীবনের। রাফি বলল, “যে ঢাকা আমাদের প্রতিদিন হাঁপিয়ে তোলে, সেই ঢাকাই এখন কত আপন লাগে, দেখো তো!”
সাদ হাসল, “এই শহরটা মানুষ ছাড়া যেমন শান্ত, তেমনি একটু নির্জনতাও কতটা দরকার বুঝতে পারি এমন দিনে।”
হাতিরঝিলে বাইক চালানো ও নৌভ্রমণ
পরের গন্তব্য হাতিরঝিল। দুপুরের শেষ ভাগে সূর্যের আলো কিছুটা নরম। তারা বাইক চালিয়ে পুরো হাতিরঝিল ঘুরলেন। চারপাশের পানি, হালকা বাতাস, আর শহরের নীরব পটভূমিতে সেই মুহূর্ত যেন সিনেমার দৃশ্য।
পরে একটি ছোট নৌকায় উঠলেন। মাঝি বলল, ঈদের দিনগুলোতে সে বাকি সময়ের চেয়ে চারগুণ বেশি আয় করতে পারে, কারণ যাত্রী কম থাকলেও সময় বেশি দিতে পারে।
গুলশান লেক পার্ক ও সূর্যাস্ত
রাত নামার আগেই পৌঁছালেন গুলশান লেক পার্কে। সূর্য ডুবছে ধীরে ধীরে। বাতাসে ঈদের মিষ্টি গন্ধ, কেউ কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, বাচ্চারা খেলছে। শান্ত পরিবেশে বসে তারা ঈদের পরিকল্পনা নিয়ে গল্প করল—কে কী রান্না করেছে, কে কোন আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিল।
রাফি বলল, “আগামী ঈদেও যদি এমন একটা দিন বের করে নিতে পারি, তবে শহরটাকে আরও ভালোবাসতে পারব।”
উত্তরার পথে ফিরে যাওয়া
রাত ৮টার দিকে তারা বাইকে চড়ে আবার উত্তরা ফিরে যেতে লাগলেন। রাস্তা এখনও বেশ ফাঁকা। ফার্মগেট, এয়ারপোর্ট সড়ক—সব কিছু যেন এক ছায়াময় স্তব্ধতায় মোড়া। শহরের আলো ঝলমলে হলেও কোলাহলহীন। তারা দুজনেই একমত, এই ঢাকা বছরের বাকি সময়ের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
একদিনের নীরব আনন্দ
ঈদের ছুটির দিনগুলোর একটি বিশাল আকর্ষণই হলো এমন ফাঁকা, শান্ত, ধোঁয়াহীন ঢাকা। এই শহরটা প্রতিদিন আমাদের কণ্ঠরোধ করে, কিন্তু মাঝে মাঝে সেও আমাদের নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেয়। রাফি ও সাদের এই একদিনের যাত্রা যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
তারা কেউ বিদেশে যাননি, সমুদ্রপাড়েও ঘুরতে যাননি, কিন্তু শহরের মধ্যেই পেয়েছেন নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের সুযোগ। এই ঢাকাকে যদি কিছুদিন পরপর এমনভাবে দেখা যেত, তাহলে হয়তো নাগরিক জীবনের কষ্টগুলোও খানিকটা সহনীয় হতো। শান্ত শহরের এমন দিনগুলো একেকটি চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে যায় স্মৃতির পাতায়।