বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪৮ হাজার থেকে ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন। বর্ষাকাল (মে থেকে সেপ্টেম্বর) সাধারণত এই রোগের শীর্ষ সময়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় এই সময়টায় সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
জাতীয় রোগ পর্যবেক্ষণ তথ্য ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় গুরুতর ফ্লু রোগীর সংখ্যা সম্প্রতি হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।
স্থানীয় ক্লিনিকগুলো জানায়, জ্বর, কাশি ও সর্দি নিয়ে ৪০ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই হার গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ
ডা. নাজমুল করিম, ঢাকার একটি বড় হাসপাতালের সিনিয়র ফিজিশিয়ান:
“এবারের ফ্লু সংক্রমণ আগের চেয়ে অনেক আক্রমণাত্মক। জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়ছে। রোগীদের অন্তত ৪০ শতাংশই কাশি, সর্দি বা জ্বর নিয়ে আসছেন।”
তিনি জানান, শিশু (৫ বছরের নিচে) ও বয়স্ক (৬৫ বছরের বেশি) রোগীদের ভর্তি হওয়ার হার অনেক বেড়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট আক্রান্তের ৫০ শতাংশই শিশু, এবং বয়স্কদের মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
রোগীর অভিজ্ঞতা
৭ বছরের রহিম ও তার মা ফাতিমা
“রহিমের জ্বর থামছিল না, পরে কাশিও শুরু হয়। আমরা ভেবেছিলাম সাধারণ ঠান্ডা, তাই দেরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
“দুই দিন আইসিইউতে ছিল। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠেছিল। আমরা ভীষণ ভয় পেয়ে যাই।”
সমাজকর্মীদের অভিমত
আয়েশা রহমান, মিরপুরের এক স্বাস্থ্যসেবাকর্মী:
“অনেক পরিবার চিকিৎসা নিতে দেরি করে, আগে বাড়িতে ঘরোয়া উপায়ে চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে তখন হাসপাতালে আসে, যেখানে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়।”
তিনি বলেন, তারা এলাকায় ৩-আর নীতি (চিনুন, পদক্ষেপ নিন, রেফার করুন) নিয়ে সচেতনতা তৈরি করছেন। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানতে বলছেন।
তাদের সংস্থা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট বিতরণ, মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ এবং কমিউনিটি সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।
কেন এবার বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
১. ভাইরাসের রূপ বদল – সংক্রমণ এখন আগের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক
২. আবহাওয়ার চরমতা – হঠাৎ ঠান্ডা-গরমে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে
৩. ভ্যাকসিন গ্রহণের হার কম – বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকাদানের জন্য কোনও জাতীয় নীতি নেই, ১% লোকও ভ্যাকসিন নেয় না
৪. দেরিতে চিকিৎসা – জ্বরকে সাধারণ ভাবায় ঘরেই চিকিৎসা করা হয়, ফলে জটিলতা বাড়ে
প্রতিরোধের উপায়: কী করবেন?
ধাপ
পরামর্শ
১. হাত ধোয়া ও মাস্ক
নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, জীবাণুনাশক ব্যবহার এবং ভিড়ের মধ্যে মাস্ক পরা
২. টিকা নেওয়া
৫ বছরের নিচের শিশু, ৬০ বছরের বেশি বয়সী, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুপারিশকৃত। টিকা পাওয়া যায় ঢাকার বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে, নিজের খরচে।
৩. দ্রুত চিকিৎসা নিন
জ্বর শুরু হওয়ার দুই দিনের মধ্যে চিকিৎসা নেওয়া উচিত, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণদের জন্য
৪. বিশ্রাম ও ওষুধ
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ, তরল খাবার ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে
৫. অসুস্থ হলে বাইরে যাবেন না
জ্বর কমার কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পর পর্যন্ত ঘরে থাকুন, অন্যদের সংক্রমণ রোধে
চিকিৎসকদের পরামর্শ
- নিজে Antibiotic খাবেন না—শুধু চিকিৎসকের নির্দেশে নিন
- জটিলতা হলে সতর্ক হোন: দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হলে দেরি না করে হাসপাতালে যান
- বয়স্ক ও দীর্ঘস্থায়ী রোগীদের জন্য সাধারণ ফ্লুও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে
মাঠ পর্যায়ের কাজ
আয়েশা রহমানের এনজিও নিচের কাজগুলো করছে:
- এলাকায় ফ্লু সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার
- মাস্ক ও স্যানিটাইজার কিট বিতরণ
- মৌসুমি চিকিৎসা ক্যাম্প ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে হাসপাতালে রেফার করা
- ঢাকায় ফ্লুর প্রকোপ অনেক বেড়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের জন্য।
- টিকা না নেওয়া, আবহাওয়ার চরমতা এবং দেরিতে চিকিৎসা নেওয়া এই ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
- প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ—হাইজিন, মাস্ক, টিকা ও সময়মতো চিকিৎসা এখন সবচেয়ে জরুরি।
- পরিবার ও কর্তৃপক্ষ—উভয়েরই উচিত সচেতনতা ও চিকিৎসা সহায়তা জোরদার করা।